Notes 21- Sura Maryam 83 to 98 Ayat

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ২১

সূরা মারইয়াম (৮৩-৯৮)

পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে কাফেরদের পথভ্রষ্টতা এবং আখিরাতে তাদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াত থেকে কাফেরদের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা এবং আখিরাতে তাদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতগুলোতে কাফেরদের গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা কারণ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে যে, শয়তানের উস্কানী এবং প্ররোচনাতেই তারা কুফুর ও নাফরমানিতে লিপ্ত হয়। শয়তান তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। তাই শয়তানের ইঙ্গিতেই তারা নাচতে থাকে।

تَؤُزُّهُمْ أَزًّا শব্দের অর্থ দ্রুত করতে চাওয়া। তার অন্য অর্থ হচ্ছে, নাড়াচাড়া দেয়া, কোন কাজের জন্যে প্রলুব্ধ করা, উৎসাহিত করা। আয়াতের অর্থ এই যে, শয়তানরা কাফেরদেরকে মন্দ কাজে প্রেরণা যোগাতে থাকে, মন্দ কাজের সৌন্দর্য অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে দেয় এবং সেগুলোর অনিষ্টের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে দেয় না। তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে থাকে। সীমালঙ্গন করতে দেয়।

এর মানে হচ্ছে, এদের বাড়াবাড়ির কারণে তাদের জন্য আযাবের দোআ করবেন না। কারণ, এদের দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এসেছে। পাত্র প্রায় ভরে উঠেছে। আল্লাহর দেয়া অবকাশের মাত্র আর ক’দিন বাকি আছে। এ দিনগুলো পূর্ণ হতে দিন। সুতরাং আপনি তাদের শাস্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। শাস্তি সত্বরই হবে। কেননা, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে বসবাসের জন্যে যে গুনাগুনতি দিন ও সময় দিয়েছি, তা দ্রুত পূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর শাস্তিই শাস্তি।

যারা বাদশাহ, অথবা কোন শাসনকতাঁর কাছে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে বাহনে চড়ে গমন করে, তাদেরকে وفد বলা হয়।  আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ঈমানদারদেরকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাদের প্রভুর সমীপে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদেরকে জান্নাত ও সম্মানিত ঘরে প্রবেশ করানো হবে। পরবর্তী আয়াতে এর উল্টো চিত্ৰই ফুটে উঠেছে। সেখানে অপরাধীদেরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করানোর কথা বলা হয়েছে।

وَفد শব্দটি وَافِد শব্দের বহুবচন, যেমন رَكب শব্দটি رَاكِب শব্দের বহুবচন। অর্থ এই যে, সেদিন পরহেযগার ও সাধানীদেরকে উট ও ঘোড়ার উপর চড়িয়ে অত্যন্ত ইয্যত ও সম্মানের সাথে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। وِردًا এর অর্থ পিপাসার্ত। অর্থাৎ, তাঁদের বিপরীত অপরাধীদেরকে ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।

عهد অৰ্থ অঙ্গীকার আদায় করা। বলা হয়ে থাকে, বাদশাহ এ অঙ্গীকার নামা অমুকের জন্য দিয়েছেন।যেটাকে সহজ ভাষায় পরোয়ানা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ যে পরোয়ানা হাসিল করে নিয়েছে তার পক্ষেই সুপারিশ হবে এবং যে পরোয়ানা পেয়েছে সে-ই সুপারিশ করতে পারবে। আয়াতের শব্দগুলো দু’দিকেই সমানভাবে আলোকপাত করে। সুপারিশ কেবলমাত্র তার পক্ষেই হতে পারবে যে রহমান থেকে পরোয়ানা হাসিল করে নিয়েছে, একথার অর্থ হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই’ এ সাক্ষ্য দিয়েছে এবং সেটার হক আদায় করেছে। ইবন আব্বাস বলেন, পরোয়ানা হচ্ছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে কোন প্রকার শক্তি-সামৰ্থ ও উপায় তালাশ না করা, আল্লাহ ব্যতীত কারও কাছে আশা না করা।

إَدّ এর অর্থঃ ভয়ানক ব্যাপার বা বীভৎস কান্ড। এ বিষয় এর আগেও আলোচিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহর সন্তান আছে’ বলা এত বড় অপরাধ যে, এই অপরাধে আকাশ-পৃথিবী বিদীর্ণ হতে পারে এবং পাহাড়-পর্বত চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে পারে।

আলোচ্য আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করলে বিশেষতঃ আল্লাহর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করলে পৃথিবী, পাহাড় ইত্যাদি ভীষণরূপে অস্থির ও ভীত হয়ে পড়ে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “খারাপ কথা শোনার পর মহান আল্লাহর চেয়ে বেশী ধৈর্য-সহনশীল আর কেউ নেই, তাঁর সাথে শরীক করা হয়, তাঁর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করা হয় তারপরও তিনি তাদেরকে নিরাপদ রাখেন এবং তাদেরকে জীবিকা প্ৰদান করেন ৷ [বুখারী: ৬০৯৯, মুসলিম: ২৮০৪]

আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে সম্যক জানেন। তিনি সেগুলোকে সীমাবদ্ধ করে গুণে রেখেছেন সুতরাং তাঁর কাছে কোন কিছু গোপন থাকতে পারে না। সৃষ্টির শুরু থেকে ছোট বড়, পুরুষ মহিলা সবই তাঁর জ্ঞানে রয়েছে।

ইবনে আব্বাস বলেন, এর অর্থ দুনিয়ার মানুষের মধ্যে তার জন্য তিনি ভালবাসা তৈরী করেন। অন্য অর্থ হচ্ছে, তিনি নিজে তাকে ভালবাসেন, অন্য ঈমানদারদের মনেও ভালবাসা তৈরী করে দেন। মুজাহিদ ও দাহহাক এ অর্থই করেছেন। ইবন আব্বাস থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি মুসলিমদের মধ্যে দুনিয়াতে তার জন্য ভালবাসা, উত্তম জীবিকা ও সত্যকথা জারী করেন। সুতরাং ঈমান ও সৎকর্মে দৃঢ়পদ ব্যক্তিদের জন্যে আল্লাহ তা’আলা বন্ধুত্ব ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ঈমান ও সংকর্ম পূর্ণরূপে পরিগ্রহ করলে এবং বাইরের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হলে ঈমানদার সৎকর্মশীলদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়ে যায়।

একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি অন্য একজন সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তির সাথে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং অন্যান্য মানুষ ও সৃষ্টজীবের মনেও আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি মহব্বত সৃষ্টি করে দেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে পছন্দ করেন, তখন জিবরীলকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালবাসি তুমিও তাকে ভালবাস। তারপর জিবরীল সব আসমানে একথা ঘোষণা করেন এবং তখন আকাশের অধিবাসীরা সবাই সেই বান্দাকে ভালবাসতে থাকে। এরপর এই ভালবাসা পৃথিবীতে নাযিল করা হয়। ফলে পৃথিবীর অধিবাসীরাও তাকে ভালবাসতে থাকে ৷ [বুখারীঃ ৫৬৯৩, মুসলিমঃ ২৬৩৭, তিরমিযীঃ ৩১৬১, এ বর্ণনায় আরও এসেছে, তারপর বর্ণনাকারী উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করলেন]

সালফে সালেহীনদের মধ্য থেকে হারেম ইবনে হাইয়ান বলেনঃ যে ব্যক্তি সর্বান্তকরণে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করে, আল্লাহ তা’আলা সমস্ত ঈমানদারের অন্তর তার দিকে নিবিষ্ট করে দেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কোন মানুষ ভাল কিংবা মন্দ যে আমলাই করুক তাকে আল্লাহ সে আমলের চাদর পরিধান করিয়ে দেন। [ইবন কাসীর]

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন স্ত্রী হাজেরা ও দুগ্ধপোষ্য সন্তান ইসমাইল আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নির্দেশে মক্কার শুষ্ক পর্বতমালা বেষ্টিত মরুভূমিতে রেখে সিরিয়া প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করেন, তখন তাদের জন্যে দোআ করে বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার নিঃসঙ্গ পরিবার পরিজনের প্রতি আপনি কিছু লোকের অন্তর আকৃষ্ট করে দিন।” এ দো’আর ফলেই হাজারো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখনও মক্কা ও মক্কাবাসীদের প্রতি মহব্বতে সমগ্ৰ বিশ্বের অন্তর আপ্লুত হচ্ছে। বিশ্বের প্রতি কোণ থেকে দুরতিক্রমা বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে সারা জীবনের উপার্জন ব্যয় করে মানুষ এখানে পৌছে এবং বিশ্বের কোণে কোণে যে দ্রব্যসামগ্ৰী উৎপাদিত হয়, তা মক্কার বাজারসমূহে পাওয়া যায়।

কুরআনকে সহজ করে দেওয়ার অর্থ ঐ ভাষায় অবতীর্ণ করা যা নবী (সাঃ) জানতেন, অর্থাৎ আরবী ভাষায়। এ ছাড়া তার বিষয়-বস্তুর স্পষ্টতা ও সরলতা এই অর্থের শামিল।

لُدّ শব্দটি ألَدّ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ ঝগড়াটে, বিতর্ক-প্রিয়। এখানে কাফের ও মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে।

বোধগম্য নয়- এমন ক্ষীণতম শব্দকে ركز বলা হয়। আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যে সমস্ত জাতিকে ধ্বংস করেছি, যেমন নূহ, আদ, সামুদ, ফিরআউন ইত্যাদি রাজ্যাধিপতি, জাঁকজমকের অধিকারী ও শক্তিধরদেরকে যখন আল্লাহ তা’আলার আযাব পাকড়াও করে ধ্বংস করে দেয়। তখন তাদের কোন ক্ষীণতম শব্দ এবং আচরণ আলোড়ন শোনা যায় না। তাদের সবাইকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, কাউকেই ছেড়ে দেয়া হয় না। বরং তাদের ধ্বংস পরবর্তদের জন্য শিক্ষণীয় হয়েই আছে।

ফুটনোট

* এ সূরা ৭২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যারা মুত্তাকী তারা পুলসিরাত পার হতে পারবে। ৮৫ নং আয়াতেও উল্লেখ করা হচ্ছে কিয়ামতের কঠিন মুহুর্তে মুত্তাকীদের সম্মানিত করা হবে এবং তারা মেহমান হিসাবে থাকবে।

* কুরআনকে সহজ করে নাযিল করা হয়েছে যাতে মুত্তাকীরা এ থেকে সুখবর নিতে পারে।

* কিয়ামতের দিন সবাই একাকী আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়াতে হবে।

* আমাদের পূর্বে কত জাতি ছিল, কত ক্ষমতাশালী জাতি/ ব্যক্তি ছিল আজ অনেক নিশানা নাই। অনেকে ইতিহাসের পাতায় ঘৃনিত। এইগুলোতে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।