Notes 23- Sura Kahf 18 to 31

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্ব ২৩

পূর্ববর্তী আয়াতগুলো থেকে আসহাবে কাহাফের ঘটনা কিছু অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। এই পর্বের আয়াতগুলোতে আসহাবে কাহাফের ঘটনার বাকি অংশ রয়েছে।

অর্থাৎ আপনি যদি তাদেরকে গুহায় অবস্থানকালে দেখতে পেতেন তাহলে মনে করতেন যে, তারা জেগে আছে অথচ তারা ঘুমন্ত। তাদেরকে জেগে আছে মনে করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে, তারা পাশ ফিরাচ্ছে। আর যারা পাশ ফিরে শুতে পারে তারা সামান্য হলেও জাগ্রত হয়। অথবা কারও কারও মতে, তারা ঘুমন্ত হলেও তাদের চোখ খোলা থাকত।

কেউ বাইর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেও তাদের সাতজনের মাঝে মাঝে পার্শ্বপরিবর্তন করতে থাকার কারণে এ ধারণা করতো যে, এরা এমনিই শুয়ে আছে, ঘুমুচ্ছে না। পার্শ্ব পরিবর্তনের কারণ কারও কারও মতে, যাতে যমীন তাদের শরীর খেয়ে না ফেলে।

পাহাড়ের মধ্যে একটি অন্ধকার গুহায় কয়েকজন লোকের এভাবে অবস্থান করা এবং সামনের দিকে কুকুরের বসে থাকা এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য পেশ করে যে, উঁকি দিয়ে যারা দেখতো তারাই ভয়ে পালিয়ে যেতো। তাছাড়া আল্লাহ তাদের উপর ভীতি ঢেলে দিয়েছিলেন, সুতরাং যে কেউ তাদের দেখত, তারই ভয়ের উদ্রেক হতো।

এখানে দু’টি ঘটনার পারস্পরিক তুলনা বোঝানো হয়েছে। প্রথম ঘটনা আসহাবে কাহফের দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিদ্রাভিভূত থাকা, যা কাহিনীর শুরুতে (فَضَرَبْنَا عَلَىٰ آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ) আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনা দীর্ঘকালীন নিদ্রার পর সুস্থ থাকা এবং খাদ্য না পাওয়া সত্বেও সবল ও সুঠাম দেহে জাগ্রত হওয়া। উভয় ঘটনা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন হওয়ার ব্যাপারে পরস্পর তুল্য। তাই এ আয়াতে তাদেরকে জাগ্রত করার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে كَذَٰلِكَ ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাদের নিদ্রা যেমন সাধারণ মানুষের নিদ্রার মত ছিল না, তেমনি তাদের জাগরণও স্বতন্ত্র ছিল। এখানে বর্ণিত لِيَتَسَاءَلُوا এর ل টিকে বলা হয়, لام صيرورة বা لام العاقبة যার অর্থ পরিণামে যাতে এটা হয়। অর্থাৎ তাদেরকে জাগ্রত করার পরিণাম যেন এই দাঁড়ায়।

মোটকথা, তাদের দীর্ঘ নিদ্রা যেমন কুদরতের একটি নিদর্শন ছিল, এমনিভাবে শতশত বছর পর পানাহার ছাড়া সুস্থ-সবল অবস্থায় জাগ্রত হওয়াও ছিল আল্লাহর অপার শক্তির একটি নিদর্শন।

আল্লাহর এটাও ইচ্ছা ছিল যে, শত শত বছর নিদ্ৰামগ্ন থাকার বিষয়টি স্বয়ং তারাও জানুক। তাই পারস্পরিক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এর সূচনা হয় এবং সে ঘটনা দ্বারা চূড়ান্ত রূপ নেয়, যা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের গোপন রহস্য শহরবাসীরা জেনে ফেলে এবং সময়কাল নির্ণয়ে মতানৈক্য সত্বেও দীর্ঘকাল গুহায় নিদ্রামগ্ন থাকার ব্যাপারে সবার মনেই বিশ্বাস জন্মে। আর তারা মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্পর্কে আল্লাহর শক্তির কথা স্মরণ করে। বস্তুত: যে অদ্ভূত পদ্ধতিতে তাদেরকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল এবং দুনিয়াবাসীকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে বেখবর রাখা হয়েছিল ঠিক তেমনি সুদীর্ঘকাল পরে তাদের জেগে উঠাও ছিল আল্লাহর শক্তিমত্তার বিস্ময়কর প্রকাশ।

আসহাবে কাহ্‌ফের এক ব্যক্তি প্রশ্ন তুলল যে, তোমরা কতকাল নিদ্রামগ্ন রয়েছ? কেউ কেউ উত্তর দিল: একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ। কেননা, তারা সকাল বেলায় গুহায় প্রবেশ করেছিল এবং জাগরণের সময়টি ছিল বিকাল। তাই মনে করল যে, এটা সেই দিন যেদিন আমরা গুহায় প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু তাদের মধ্য থেকেই অন্যরা অনুভব করল যে, এটা সম্ভবতঃ সেই দিন নয়। তাহলে কতদিন গেল জানা নেই। তাই তারা বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে (رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ) অতঃপর তারা এ আলোচনাকে অনাবশ্যক মনে করে জরুরী কাজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল যে, শহর থেকে কিছু খাদ্য আনার জন্য একজনকে পাঠানো হোক।

আসহাবে কাহ্‌ফ নিজেদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে শহরে প্রেরণের জন্য মনোনীত করে এবং খাদ্য আনার জন্য তার কাছে অর্থ অৰ্পণ করে। এ থেকে কয়েকটি বিষয় জানা যায়। (এক) অর্থ-সম্পদে অংশীদারিত্ব জায়েয। (দুই) অর্থ-সম্পদের উকিল নিযুক্ত করা জায়েয এবং শরীকানাধীন সম্পদ কোন এক ব্যক্তি অন্যদের অনুমতিক্রমে ব্যয় করতে পারে। (তিন) খাদ্যদ্রব্যে কয়েকজন সঙ্গী শরীক হলে তা জায়েয; যদিও খাওয়ার পরিমাণ বিভিন্নরূপ হয়- কেউ কম খায়। আর কেউ বেশী খায়।

অর্থাৎ, যেভাবে আমি তাদেরকে ঘুম পাড়িয়েছি ও জাগিয়েছি, অনুরূপভাবে মানুষদেরকেও তাদের ব্যাপারে অবহিত করিয়েছি। কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী এই অবহিত করণ এইভাবে সুসম্পন্ন হয় যে, যখন গুহা অধিবাসীদের একজন রূপার সেই মুদ্রা নিয়ে শহরে গেল, যা ৩০০ বছর পূর্বের রাজা দাকয়ানুসের আমলে প্রচলিত ছিল এবং সেই মুদ্রা সে একজন দোকানদারকে দিল, তখন সে বিস্মিত হল। সে পাশের দোকানদারকেও দেখাল। তারাও আশ্চর্যানিত হল। এদিকে এ লোক তাদেরকে বলছিল যে, আমি এই শহরেরই অধিবাসী, গত কালই এখান থেকে গেছি। কিন্তু এই ‘কাল’এর যে তিন শতাব্দি অতিবাহিত হয়ে গেছে। অতএব মানুষ কিভাবে তার কথা মেনে নিবে? লোকদের এই সন্দেহ হল যে, হতে পারে এ লোক কোন গুপ্ত ধন-ভান্ডার পেয়েছে। পরিশেষে ধীরে ধীরে এ কথা রাজা বা শাসক পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং সে (গুহা অধিবাসীদের) এই সঙ্গীর সাহায্যে গুহা পর্যন্ত যায় এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। পরে মহান আল্লাহ পুনরায় তাদেরকে সেখানেই মৃত্যু দেন।

গুহার অধিবাসীদের এই ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার এবং মৃত্যুর পর আল্লাহর পুনরুত্থানের ওয়াদা সত্য। অস্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে এই ঘটনার মধ্যে আল্লাহর মহাশক্তির এক নিদর্শন।

তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল তারা বলল, আমরা তো নিশ্চয় তাদের পাশে মসজিদ নির্মাণ করব।

সম্ভবত: এখানে রোম সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এবং খৃষ্টীয় গীর্জার ধৰ্মীয় নেতৃবর্গের কথা বলা হয়েছে, যাদের মোকাবিলায় সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী ঈসায়ীদের কথা মানুষের কাছে ঠাই পেতো না। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সাধারণ নাসারাদের মধ্যে বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক গীর্জাসমূহে শির্ক, আউলিয়া পূজা ও কবর পূজা পুরো জোরেশোরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুযৰ্গদের আস্তানা পূজা করা হচ্ছিল এবং ঈসা, মারইয়াম ও হাওয়ারীগণের প্রতিমূর্তি গীর্জাগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছিল। আসহাবে কাহফের নিদ্রাভিংগের মাত্র কয়েক বছর আগে মতান্তারে ৪৩১ খৃষ্টাব্দে সমগ্র খৃষ্টীয় জগতের ধর্মীয় নেতাদের একটি কাউন্সিল এ ‘আফসোস’ নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

সেখানে ঈসা আলাইহিস সালামের ইলাহ হওয়া এবং মারইয়াম আলাইহাস সালামের “ইলাহ-মাতা” হওয়ার আকীদা চার্চের সরকারী আকীদা হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এ ইতিহাস সামনে রাখলে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে (الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَىٰ أَمْرِهِمْ) বাক্যে যাদেরকে প্রাধান্য লাভকারী বলা হয়েছে তারা হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঈসা আলাইহিস সালামের সাচ্চা অনুসারীদের মোকাবিলায় তৎকালীন খৃষ্টান জনগণের নেতা এবং তাদের শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়াবলী যাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। মূলত এরাই ছিল শির্কের পতাকাবাহী এবং এরাই আসহাবে কাহফের সমাধি সৌধ নির্মাণ করে সেখানে মসজিদ তথা ইবাদাতখানা নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা রাহেমাহুল্লাহ এ সম্ভাবনাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। [দেখুন, ইকতিদায়ুস সিরাতিল মুস্তাকীম: ১/৯০]

মুসলিমদের মধ্যে কিছু লোক কুরআন মজীদের এ আয়াতটির সম্পূর্ণ উল্টা অৰ্থ গ্রহণ করেছে। তারা এ থেকে প্রমাণ করতে চান যে, নবী-রাসূল সাহাবী ও সৎ লোকদের কবরের উপর সৌধ ও মসজিদ নির্মাণ জায়েয। অথচ কুরআন এখানে তাদের এ গোমরাহীর প্রতি ইংগিত করছে যে, এ যালেমদের মনে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও আখেরাত অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি করার জন্য তাদেরকে যে নির্দশন দেখানো হয়েছিল তাকে তারা শির্কের কাজ করার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি সুযোগ মনে করে নেয় এবং ভাবে যে, ভালই হলো পূজা করার জন্য আরো কিছু আল্লাহর অলী পাওয়া গেলো।

তাছাড়া এই আয়াত থেকে “সালেহীন” তথা সৎ লোকদের কবরের উপর মসজিদ তৈরী করার প্রমাণ কেমন করে সংগ্ৰহ করা যেতে পারে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন উক্তির মধ্যে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছেঃ কবর যিয়ারতকারী নারী ও কবরের উপর মসজিদ নির্মাণকারীদের প্রতি আল্লাহ্‌ লানত বর্ষণ করেছেন।” [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৩১৮০, মুসনাদে আহমদঃ ১/২২৯, ২৮৭, ৩২৪, তিরমিযীঃ ৩২০, আবু দাউদঃ ৩২৩৬]।

আরো বলেছেনঃ “সাবধান হয়ে যাও, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীদের কবরকে ইবাদাতখানা বানিয়ে নিতো। আমি তোমাদের এ ধরনের কাজ থেকে নিষেধ করছি।” [মুসলিমঃ ৫৩২]। আরো বলেনঃ “আল্লাহ ইয়াহুদী ও নাসারাদের প্রতি লানত বর্ষণ করেছেন। তারা নিজেদের নবীদের কবরগুলোকে ইবাদতখানায় পরিণত করেছে।” [আহমদঃ ১/২১৮, মুসলিমঃ ৩৭৬]। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “এদের অবস্থা এ ছিল যে, যদি এদের মধ্যে কোন সৎ লোক থাকতো তার মৃত্যুর পর এরা তার কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করতো এবং তার ছবি তৈরী করতো। এরা কিয়ামতের দিন নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হবে।” [বুখারীঃ ৪১৭, মুসলিমঃ ৫২৮]।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও কোন আল্লাহভীরু ব্যক্তি কুরআন মজীদে ঈসায়ী পাদ্রী ও রোমীয় শাসকদের যে ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড কাহিনীচ্ছলে বর্ণনা করা হয়েছে তাকেই ঐ নিষিদ্ধ কর্মটি করার জন্য দলীল ও প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাবার দুঃসাহস কিভাবে করতে পারে?

এ থেকে জানা যায়, এ ঘটনার পৌনে তিনশো বছর পরে কুরআন নাযিলের সময় এর বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে নাসারাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সাধারণ লোকদের জানা ছিল না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক বর্ণনার সাহায্যে ঘটনাবলী চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এবং সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাদের বহু বিবরণ গল্পের রূপ নিতো। তবুও যেহেতু তৃতীয় বক্তব্যটির প্রতিবাদ আল্লাহ করেননি তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সঠিক সংখ্যা সাতই ছিল। তাছাড়া ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলতেন। আমি সেই কম সংখ্যক লোকদের অন্যতম যারা তাদের সংখ্যা জানে, তারা সংখ্যায় ছিল সাতজন।”

তাদের সংখ্যাটি জানা আসল কথা নয়। বরং আসল জিনিস হচ্ছে এ কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করা।

এ কাহিনী থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একজন সাচ্চা মুমিনের কোন অবস্থায়ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং মিথ্যার সামনে মাথা নত করে দেবার জন্য তৈরী থাকা উচিত নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মুমিনের ভরসা দুনিয়াবী উপায় উপকরণের উপর নয় বরং আল্লাহর উপর থাকতে হবে এবং সত্যপথানুসারী হবার জন্য বাহ্যত পরিবেশের মধ্যে কোন অনুকূল্যের চিহ্ন না দেখা গেলেও আল্লাহর উপর ভরসা করে সত্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে,যে ” প্রচলিত নিয়ম”কে লোকেরা ” প্রাকৃতিক আইন ” মনে করে এবং এ আইনের বিরুদ্ধে দুনিয়ায় কিছুই হতে পারে না বলে ধারণা করে, আসলে আল্লাহর মোটেই তা মেনে চলার প্রয়োজন নেই ৷ তিনি যখনই এবং যেখানেই চান এ নিয়ম পরিবর্তন করে যে অস্বাভাবিক কাজ করতে চান করতে পারেন ৷ কাউকে দু’শো বছর ঘুম পাড়িয়ে এমনভাবে জাগিয়ে তোলা যে, সে যেন মাত্র কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়েছে এবং তার বয়স, চেহারা – সুরত, পোশাক, স্বাস্থ্য তথা কোনকিছুর ওপর একালের বিবর্তনের কোন প্রভাব না পড়া, এটা তাঁর জন্য কোন বড় কাজ নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মানব জাতির অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বংশধরদেরকে একই সংগে জীবিত করে উঠিয়ে দেয়া, যে ব্যাপারে নবী গণ ও আসমানী কিতাবগুলো আগাম খবর দিয়েছে, আল্লাহর কুদরতের পক্ষে মোটেই কোন অসম্ভব ব্যপার নয় ৷ এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অজ্ঞ ও মূর্খ মানুষেরা কিভাবে প্রতি যুগে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে নিজেদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও শিক্ষার সম্পদে পরিণত করার পরিবর্তে উল্টা সেগুলোকে নিজেদের বৃহত্তর ভ্রষ্টতার মাধ্যমে পরিণত করতো ৷ আসহাবে কাহফের অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ মানুষকে এ জন্য দেখিয়েছিলেন যে, মানুষ তার মাধ্যমে পরকাল বিশ্বাসের উপকরণ লাভ করতে, ঠিক সেই ঘটনাকেই তারা এভাবে গ্রহণ করলো যে, আল্লাহ তাদেরকে পূজা করার জন্য আরো কিছু সংখ্যক অলী ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব দিয়েছেন ৷ — এ কাহিনী থেকে মানুষকে এ আসল শিক্ষাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং এর মধ্যে এগুলোই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত বিষয় ৷ এ বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এ মর্মে অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করে দেয়া যে, আসহাবে কাহফ কতজন ছিলেন, তাদের নাম কি ছিল, তাদের কুকুরের গায়ের রং কি ছিল এসব এমন ধরনের লোকের কাজ যারা ভেতরের শাঁস ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের ছাল নিয়ে নাড়াচাড়া করা পছন্দ করে ৷ তাই মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে মুমিনদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, যদি অন্য লোকেরা এ ধরনের অসংলগ্ন বিতর্কের অবতারণা করেও তাহলে তোমরা তাতে নাক গলাবে না এবং এ ধরনের প্রশ্নর জবাব দেবার জন্য অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করবে না ৷ বরং কেবলমাত্র কাজের কথায় নিজেদের সময় ক্ষেপন করবে ৷ এ কারণেই আল্লাহ নিজেও তাদের সঠিক সংখ্যা বর্ণনা করেননি ৷

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতকালে কোন কাজ করার ওয়াদা বা স্বীকারোক্তি করলে এর সাথে “ইনশাআল্লাহ” বাক্যটি যুক্ত করতে হবে। কেননা, ভবিষ্যতে জীবিত থাকবে কিনা তা কারো জানা নেই। জীবিত থাকলেও কাজটি করতে পারবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই। কাজেই মুমিনের উচিত মনে মনে এবং মুখে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আল্লাহর উপর ভরসা করা। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার কথা বললে এভাবে বলা দরকারঃ যদি আল্লাহ চান, তবে আমি এ কাজটি আগামী কাল করব। ইনশাআল্লাহ বাক্যের অর্থ তাই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “সুলাইমান ইবনে দাউদ ‘আলাইহিমোস সালাম বললেনঃ আমি আজ রাতে আমার সত্তর জন স্ত্রীর উপর উপগত হব। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে- নব্বই জন স্ত্রীর উপগত হব, তাদের প্রত্যেকেই একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেবে যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। তখন তাকে ফিরিশতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন যে, বলুনঃ ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তিনি বললেন না। ফলে তিনি সমস্ত স্ত্রীর উপর উপনীত হলেও তাদের কেউই কোন সন্তান জন্ম দিল না। শুধু একজন স্ত্রী একটি অপরিণত সন্তান প্রসব করল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যার হাতে আমার প্রাণ, সে যদি বলত ইনশাআল্লাহ, তবে অবশ্যই তার ওয়াদা ভঙ্গ হত না। আর তা তার ওয়াদা পূর্ণতায় সহযোগী হত’৷ [বুখারীঃ ৩৪২৪, ৫২৪২,৬৬৩৯, ৭৪৬৯, মুসলিমঃ ১৬৫৪, আহমাদঃ ২/২২৯, ৫০৬]

কোন কোন মুফাসসির বলেন, আয়াতের অর্থ হলো, যখনি আপনি কোন কিছু ভুলে যাবেন তখনই আল্লাহকে স্মরণ করবেন। কারণ, ভুলে যাওয়াটা শয়তানের কারসাজির ফলে ঘটে। আর মহান আল্লাহর স্মরণ শয়তানকে দূরে তাড়িয়ে দেয় যা পুনরায় স্মরণ করতে সাহায্য করবে। এ অর্থটির সাথে পরবর্তী বাক্যের মিল বেশী। অপর কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতের সাথে মিলিয়ে অর্থ করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ইনশাল্লাহ ভুলে যান তবে যখনই মনে হবে তখনই ইনশাআল্লাহ বলে নেবেন।

এ আয়াতে একটি বিরোধপূর্ণ আলোচনার ফয়সালা করা হয়েছে। অর্থাৎ গুহায় নিদ্রামগ্ন থাকার সময়কাল। এ আয়াতের তাফসীরে কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এ বাক্যে তিনশ ও নয় বছরের যে সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে তা লোকদের উক্তি, এটা আল্লাহর উক্তি নয়। অর্থাৎ এখানে মতভেদকারীদের মত উল্লেখ করা হয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর] তবে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে যে, এখানে আল্লাহ্ তা’আলা পক্ষ থেকে তাদের গুহায় অবস্থানের কাল বর্ণনা করা হয়েছে। সে হিসাবে এ আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে যে, এই সময়কাল তিনশ’ নয় বছর। এখন কাহিনীর শুরুতে (فَضَرَبْنَا عَلَىٰ آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا) বলে যে বিষয়টি সংক্ষেপে বলা হয়েছিল, এখানে যেন তাই বর্ণনা করে দেয়া হল।

উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে আসহাবে কাহাফের ঘটনা বর্ণনার ইতি টানা হয়েছে। এখানে সর্বমোট পাঁচটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে-

১. দীর্ঘদিন পর আসহাবে কাহাফকে জাথতকরণ ও জনসম্মুখে তাদের অবস্থা প্রকাশের মধ্যে কি হিকমত ছিল?

২. মানুষের মধ্যে আসহাবে কাহাফ সম্পর্কে কিছু কিছু ব্যাপারে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল । একদল গুহার নিকট সৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছিল। অপর দল তথায় মসজিদ নির্মাণ করতে চেয়েছিল । অতঃপর মসজিদ নির্মাণকারী দল বিজয়ী হয়ে তথায় মসজিদ নির্মাণ করেন ।

৩. আসহাবে কাহাফের সংখ্যা নির্ণয়ে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। সেই. বিরোধপূর্ণ উক্তিগুলো উল্লেখ করে সঠিক সংখ্যাটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

৪. অবশেষে এই হেদায়েতও দেওয়া হয়েছে যে, আসহাবে কাহাফের যতটুকু বিবরণ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত রয়েছে, তাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে৷ অহেতুক অতিরিক্ত আলোচনা করা যাবে না । এ ব্যাপারে অন্য কারো থেকে কোনো কিছু অকাট্যরূপে জানা যাবে না। আর যদি তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব আগামীতে দেওয়ার ইচ্ছা করা হয় তবে ইনশাআল্লাহ বলে নিতে হবে।

৫. আসহাবে কাহাফ কতকাল নিদ্রিত ছিলেন?

আসহাবে কাহফের কাহিনী শেষ হবার পর এবার এখান থেকে দ্বিতীয় বিষয়বস্তুর আলোচনা শুরু হচ্ছে ৷ এ আলোচনায় মক্কায় মুসলমানরা যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন সে সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে ৷

মক্কার কারফেরদেরকে উদ্দেশ্য করে এর মধ্যে ব্যক্তব রাখা হয়েছে, যদিও বাহ্যত সম্বোধন করা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ৷ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কাফেরদেরকে একথা বলা যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কালামের মধ্যে নিজের পক্ষ থেকে কোন কিছু কমবেশী করার অধিকার রাখেন না ৷ তাঁর কাজ শুধু এতটুকু, আল্লাহ যা কিছু নাযিল করেছেন তাকে কোন কিছু কমবেশী না করে হুবুহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন ৷ তুমি যদি মেনে নিতে চাও তাহেল বিশ্বজাহানের প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দীন পেশ করা হয়েছে তাকে পুরোপুরি হুবুহু মেনে নাও ৷ আ যদি না মানতে চাও তাহেল সেটা তোমার খুশী তুমি মেনে নিয়ো না ৷ কিন্তু কোন অবস্থায় এ আশা করো না যে, তোমাকে রাজী করার জন্য তোমার খেয়াল খুশীমতো এ দীনের মধ্যে কোন আংশিক পর্যায়ের হলেও কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করা হবে ৷ কাফেরদেরক পক্ষ থেকে বার বার এ মর্মে যে দাবী করা হচ্ছিল যে, আমরা তোমার কথা পুরোপুরি মেনে নেবো এমন জিদ ধরে বসে আছো কেন? আমাদে পৈতৃক দীনের আকীদা – বিশ্বাস ও রীতি – রেওয়াজের সুবিধা দেবার কথাটাও একটু বিবেচনা করো ৷ তুমি আমাদেরটা কিছু মেনে নাও এবং আমরা তোমারটা কিছু মেনে নিই ৷ এর ভিত্তিতে সমঝোতা হতে পারে এবং এভাবে গোত্রীয় সমপ্রীতি ও ঐক্য অটুট থাকতে পারে ৷ এটি হচ্ছে কাফেরদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এবং দাবীর জওয়াব ৷ কুরআনে একাধিক জায়গায় তাদের এ দাবী উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর এ জওয়াবই দেয়া হয়েছে ৷ উদাহরণ স্বরূপ সূরা ইউনুসের ১৫ আয়াতটি দেখুন ৷ বলা হয়েছে : ” যখন আমার আয়াত তাদেরকে পরিস্কার শুনিয়ে দেয়া হয় তখন যারা কখনো আমার সামনে হাযির হবার আকাংখা রাখে না তারা বলে, এ ছাড়া অন্য কোন কুরআন নিয়ে এসো অথবা এর মধ্যে কিছু কাটছাঁট করো ৷ “

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর স্মরণে অনুষ্ঠিত মজলিসে যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে একত্রিত হবে তাদের ব্যাপারে আকাশ থেকে আহবান করে বলা হয় তোমরা যখন তোমাদের মজলিস শেষ করবে তখন তোমরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। আর তোমাদের গোনাহসমূহ সৎকাজে পরিবর্তিত হবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৩/১৪২]

এ আয়াতটির মূল বক্তব্য সূরা আল-আন’আমের ৫২ নং আয়াতের মতই। সেখানে আয়াত নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে যে, কাফেরদের আব্দার ছিল, আপনি যদি গরীব মুসলিমদেরকে আপনার মজলিস থেকে দূরে সরিয়ে দেন তবেই আমরা আপনার সাথে বসার কথা চিন্তা করে দেখতে পারি? [দেখুন, মুসলিম: ২৪১৩, মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৬১]

এ ধরণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতে তাদের পরামর্শ গ্ৰহণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শুধু নিষেধই নয়- নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনি নিজেকে তাদের সাথে বেঁধে রাখুন। সম্পর্ক ও মনোযোগ তাদের প্রতি নিবদ্ধ রাখুন। কাজেকর্মে তাদের কাছ থেকেই পরামর্শ নিন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা সকাল-সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদাত ও যিকর করে। তাদের কার্যকলাপ একান্তভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত। অপরদিকে কাফেরদের মন আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল এবং তাদের সমস্ত কার্যকলাপ তাদের খেয়ালখুশীর অনুসারী। এসব অবস্থা মানুষকে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

এখানে এসে পরিস্কার বুজা যায় আসহাবে কাহফের কাহিনী শুনাবার পর কোন উপলক্ষে এ বাক্যটি এখানে বলা হয়েছে ৷ আসহাবে কাহফের যে কাহিনী ওপরে বর্ণনা করা হেযছে তাতে বলা হয়েছিল, তাওহীদের প্রতি ঈমান আনার পর তারা কিভাবে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে দেন, ” আমাদের রব তো একমাত্র তিনিই যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রব ৷ ” তারপর কিভাবে তারা নিজেদের পথভ্রষ্ট জাতির সাথে কোনভাবেই আপোস করতে রাযী হননি বরং পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে বলে দেন, ” আমরা তাঁকে ছড়া অন্য কোন ইলাহকে ডাকবো না ৷ যদি আমরা এমনটি করি তাহলে তা হবে বড়ই অসংগত ও অন্যায় কথা ৷ ” কিভাবে তারা নিজেদের জাতি ও তার উপাস্যদের ত্যাগ করে কোন প্রকার সাহায্য – সহায়তা ও সাজসরঞ্জাম ছাড়াই গুহার মধ্যে লুকিয়ে জীবন যাপন করা ব্যবস্থা করেছিল কিন্তু সত্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে গিয়ে নিজের জাতির সাথে আপোস করতে প্রস্তুত হয়নি ৷ তারপর যখন তারা জেগে উঠলেন তখনও তারা যে বিষয়ে চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন সেটি হচ্ছে এই যে আল্লাহ না করুন, যদি তাদের জাতি কোনভাবে তাদেরকে নিজেদের ধর্মের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাহলে তারা কখনো সাফল্য লাভ করতে পারবে না ৷ এসব ঘটনা উল্লেখ করার পর এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে — আর আসলে ইসলাম বিরোধীদেরকে শুনাবার উদ্দেশ্যেই তাঁকে বলা হচ্ছে — যে , এ মুশরিক ও সত্য অস্বীকারকারী গোষ্ঠীর সাথে আপোস করার আদৌ কোন প্রশ্নই ওঠে না ৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে তাকে হুবুহু তাদের সামনে পেশ করে দাও ৷ যদি তারা মানতে চায় হহলে মেনে নিক আর যদি না মানতে চায় তাহেল নিজেরাই অশুভ পরিণামের মুখোমুখি হবে ৷ যারা মেনে নিয়েছে তারা কম বয়েসী যুবক অথবা অর্থ ও কপর্দকহীন ফকীর, মিসকীন, দাস বা মজুর যেই হোক না কেন তারাই মহামূল্যবান হীরার টুকরা এবং তাদেরকেই এখানে প্রিয়ভাজন করা হবে ৷ তাদেরকে বাদ দিয়ে এমন সব বড় বড় সরদার ও প্রধানদেরকে কোন কাজেই গ্রাহ্য করা হবে না তারা যত বেশী দুনিয়াবী শান শওকতের অধিকারী হোন না কেন তারা আল্লাহ থেকে গাফিল এবং নিজেদের প্রবৃত্তির দাস ৷

 

প্রাচীনকালে রাজা বাদশাহরা সোনার কাঁকন পরতেন। [ফাতহুল কাদীর] জন্নাতবাসীদের পোশাকের মধ্যে এ জিনিসটির কথা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানিয়ে দেয়া যে, সেখানে তাদেরকে রাজকীয় পোশাক পরানো হবে। একজন কাফের ও ফাসেক বাদশাহ সেখানে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে এবং একজন মুমিন ও সৎ মজদুর সেখানে থাকবে রাজকীয় জৌলুসের মধ্যে।

বলা হয়েছে তারা আসন গ্ৰহণ করবে। আরাইক এ। এ ‘আরাইক’ শব্দটি বহুবচন। এর এক বচন হচ্ছে ‘আরীকাহ’ আরবী ভাষায় আরাকাহ এমন ধরনের আসনকে বলা হয় যার উপর ছত্ৰ খাটানো আছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] এর মাধ্যমেও এখানে এ ধারণা দেয়াই উদ্দেশ্য যে, সেখানে প্রত্যেক জান্নাতী রাজকীয় সিংহাসনে অবস্থান করবে।

সূরা আল-ফুরকানের ৭৫–৭৬ নং আয়াতেও জান্নাতবাসীদের অবস্থানস্থল সম্পর্কে অনুরূপ উক্তি করা হয়েছে।

 

ফুটনোট 

*  চিন্তা ও গবেষণা করে কুরআন ও কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো অধ্যয়ন করা উচিৎ।
* বিনা প্রয়োজনে মতভেদ করা অর্থহীন। যেমন গুহাবাসীদের নাম, কুকুরটির নাম ও তার রং সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করে কোন লাভ নেই।
* ভবিষ্যতে কোন কাজ করতে ইচ্ছা করলে প্রথমে ইনশা-আল্লাহ্ বলতে হেব।
* প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সত্যের উপর অবিচল থাকার গুরুত্ব অপরিসীম।
* আসহাবে কাহাফের স্থান ও কাল কুরআন ও সহীহ হাদীছে উল্লেখ করা হয় নি। সুতরাং তা খুঁজে বেড়ানোতে আমাদের কোন লাভ নেই। ঘটনাটি ঐ প্রকার গায়েবের অন্তর্ভূক্ত, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে জানিয়েছেন। তবে তার স্থান ও কাল আমরা জানতে পারি নি।
* নবী সাল্লাল্লাহু গায়েবের সকল খবর জানতেন না। যদি জানতেন, তাহলে অহীর অপেক্ষায় না থেকে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই তাদেরকে ঘটনাটি বলে দিতেন।
* আসহাবে কাহাফগণ যে গুহায় অবস্থান করেছিলেন তাও গায়েবের অন্তর্ভূক্ত। এর ঠিকানা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কেউ যদি এর স্থান নির্দিষ্ট করে বলে সে আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনাকারীর অন্তর্ভূক্ত হবে।
* তাওহীদ ও শির্কের মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরী। অন্যথায় তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব নয়।
* তিন শত নয় বছর পর তাদেরকে জীবিত করা এটাই প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সত্য, কিয়ামত সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।
* রূহ এবং দেহ উভয়েরই পুনরুত্থান হবে। কেননা আসহাবে কাহাফগণ এভাবেই জীবিত হয়েছিলেন।
* রক্তের সম্পর্কের চেয়ে ঈমানের সম্পর্ক অধিক মজবুত হওয়া আবশ্যক। ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকলেও ঈমান ও তাওহীদের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে একই পথের পথিক হয়ে যান।
* হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দার প্রতি বিরাট একটি নেয়ামত। বান্দার উচিত সর্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে হেদায়াত প্রার্থনা করা।
* ঘরের মধ্যে কুকুর রাখা নিষিদ্ধ। তাই কুকুরটিকে গুহার বাইরে রাখা হয়েছিল।
* ভাল লোকের সঙ্গে থাকলে ভাল বলে হওয়া যায় এবং ভাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। কুকুরটি তাদের সাথে থাকার কারণে কুরআনে তার নাম উল্লেখিত হয়েছে। অপর পক্ষে অসৎ লোকের সঙ্গে থাকলে অসৎ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিরাপদ নয়।
* কবরের উপর মসজিদ বা গম্বুজ নির্মাণ করা আমাদের শরীয়তে নিষিদ্ধ।
* বয়স বৃদ্ধি হলে এবং অভিজ্ঞতা দীর্ঘ হলেই মানুষ জ্ঞানী হয়ে যায় না। এই যুবকগণ বয়সে কম হলেও তারা সত্য উদঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই জাতির মধ্যে অসংখ্য বয়স্ক ও অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও সঠিক পথের সন্ধান পায় নি।
* এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে সূর্য চলমান; স্থির নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদের গুহা থেকে পাশ কেটে ডানদিকে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায়, তাদের থেকে পাশ কেটে বামদিকে চলে যায়।
* প্রহরী হিসেবে কুকুর প্রতিপালন করা জায়েয আছে।

* কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তা আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে বলতে হবে আল্লাহই ভাল জানেন।
* আল্লাহ কখনও দ্বীনের দাঈদের ঈমানী শক্তি পরীক্ষা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদেরকে শক্তিশালী করে দেন। তখন দাঈদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা।
* তারা সংখ্যায় ছিলেন সাত জন। কারণ আল্লাহ তাআলা প্রথম দু’টি সংখ্যার প্রতিবাদ করে তৃতীয়টির ক্ষেত্রে কিছুই বলেন নি। এতে বুঝা গেল শেষ সংখ্যাটিই সঠিক।
* যে ব্যক্তি ফতোয়া দেয়ার যোগ্য নয়, তার কাছে ফতোয়া চাওয়া ঠিক নয়।

 

আল্লাহ তায়ালা কেবল যে ঐ তরুণদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, এমন না। ঘটনাটি বর্ণনা করা শেষে আমাদের জন্যে শিক্ষামূলক যে আয়াতগুলো বর্ণনা করেছেন, সেখানেও বলা হচ্ছে যে, সমাজের খারাপ মানুষদের থেকে ভালো মানুষেরা বের হয়ে গিয়ে আলাদা সবাই একসাথে সঙ্ঘবদ্ধভাবে জীবনযাপন করবে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন –

তুমি নিজেকে ধৈর্য সহকারে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখ যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে। তুমি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, তুমি তার আনুগত্য করবেন না।
[সূরা কাহাফ, আয়াত – ২৮]

সমাজের বিভিন্ন ফিতনা থেকে বাঁচতে হলে ভালো মানুষগুলো সমাজের খারাপ মানুষদের বলয় থেকে বের হয়ে নিজেরা নিজেরা একসাথে সঙ্ঘবদ্ধভাবে জীবনযাপন করতে হয়। এতে পার্থিব জগতের সৌন্দর্য কম থাকলেও প্রশান্ত মনে জীবনযাপন করা সম্ভব হয়ে উঠে।

তাই, সমাজ পরিবর্তন করতে হলে একটি ধর্মহীন সমাজকে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করার চেয়ে আল কোর’আনের সাহায্যে ধৈর্য সহকারে নিজের মত করে একটি ভালো সমাজ গড়ে তোলাই এই ঘটনাটির শিক্ষা।