কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২
প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ৪
সূরা বাইয়্যিনাহ
কুরআন মাজীদের ৯৮ তম সূরা। এতে রয়েছে ৮টি আয়াত এবং ১টি রুকু। সূরাটি মাদানী সূরা। আল বাইয়্যিনাহ অর্থ সুস্পষ্ট প্রমাণ।
নামকরণ
প্রথম আয়াতের শেষ আল বাইয়েনাহ (لَمۡ یَکُنِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ مُنۡفَکِّیۡنَ حَتّٰی تَاۡتِیَهُمُ الۡبَیِّنَۃُ ) থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
সর্বপ্রথম রসূল পাঠাবার প্রয়োজন বর্ণনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, আহলি কিতাব ও মুশরিক নির্বিশেষ দুনিয়াবাসীরা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে।একজন রসূল পাঠানো ছাড়া এই কুফরীর বেড়াজাল ভেদ করে তাদের বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। এ রসূলের অস্তিত্ব তাঁর রিসালাতের জন্য সুম্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হতে হবে এবং তিনি লোকদের সামনে আল্লাহর কিতাবকে তার আসল ও সঠিক আকৃতিতে পেশ করবেন। অতীতের আসমানী কিতাবসমূহে যেমন বাতিলের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল তেমন কোন মিশ্রণ তাতে থাকবে না এবং হবে পুরোপুরি সত্য ও সঠিক শিক্ষা সমন্নিত ।
এরপর আহলি কিতাবদের গোমরাহী তুলে ধরা হয়েছে , বলা হয়েছে তাদের এই বিভিন্ন ভুল পথে ছুটে বেড়ানোর মানে এ নয় যে , আল্লাহ তাদেরকে পথ দেখাননি। বরং তাদের সামনে সঠিক পথের বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে এসে যাবার পরপরই তারা ভুল পথে পাড়ি জমিয়েছে । এ থেকে স্বাভাবিকভাবে প্রমাণ হয় , নিজেদের ভুলের জন্য তার নিজেরাই দায়ী । এখন আবার আল্লাহর এই রসূলের মাধ্যমে সত্য আর এক দফা সুস্পষ্ট হবার পরও যদি তারা বিভ্রান্তের মতো ভুল পথে ছুটে বেড়াতে থাকে তাহলে তাদের দায়িত্বের বোঝা আরো বেশী বেড়ে যাবে।
এ প্রসংগে বলা হয়েছে , মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব নবী এসেছিলেন তাঁরা সবাই একটি মাত্র হুকুম দিয়েছিলেন এবং যেসব কিতাব পাঠানো হয়েছিল সেসবে একটি মাত্র হুকুমই বর্ণিত হয়েছিল।সেটি হচ্ছে : সব পথ ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করো। তাঁর ইবাদাত , বন্দেগী ও আনুগত্যের সাথে আর কারোর ইবাদাত – বন্দেগী , আনুগত্য ও উপাসনা আরাধনা শামিল করো না। নামায কায়েম করো এবং যাকাত দাও। চিরকাল এটিই সঠিক দীন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। এ থেকেও স্বাভাবিকভাবে একথাই প্রমাণিত হয় যে, আহলি কিতাবরা এই আসল দীন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের ধর্মে যেসব নতুন নতুন কথা বাড়িয়ে নিয়েছে সেগুলো সবই বাতিল। আর আল্লাহর এই নবী যিনি এখন এসেছেন তিনি তাদেরকে এই আসল দীনের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দিচ্ছেন।
সবশেষে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া হয়েছে, যেসব আহলি কিতাব ও মুশরিক এই রসূলকে মেনে নিতে অস্বীকার করবে তারা নিকৃষ্টতম সৃষ্টি । তাদের শাস্তি চিরন্তন জাহান্নাম। আর যারা ঈমান এনে সৎকর্মের পথ অবলম্বন করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করবে তারা সর্বোত্তম সৃষ্টি। তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। এই তাদের পুরস্কার । আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও হয়েছে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
সূরার ফযীলত
এই সূরার দ্বিতীয় নাম হল ‘সূরা লাম ইয়াকুন’ হাদীসে বর্ণিত যে, একদা নবী (সাঃ) উবাই বিন কা’ব (সাঃ)-কে বললেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা আমাকে আদেশ করেছেন যে, আমি তোমাকে ‘লাম ইয়াকুনিল্লাযীনা কাফারু’ সূরাটি পাঠ করে শুনাব।’’ উবাই (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কি আপনার কাছে আমার নাম উল্লেখ করেছেন?’ তিনি (সাঃ) বললেন, ‘‘হ্যাঁ!’’ অতঃপর এই খুশীতে উবাই (রাঃ)-এর চোখে অশ্রু এসে গেল। (সহীহ বুখারী তাফসীর সূরা ‘লাম ইয়াকুন’ পরিচ্ছেদ)
আগের সূরার ও পরের সূরার সাথে সম্পর্ক
৯৭ নং সূরা আল ক্বদর এ বর্নিত হয়েছে কখন ওহী আসা শুরু হয়েছিল? ৯৮ নং সূরা আল বায়্যিনাহ এ বর্নিত হয়েছে ওহী আসলে কি? এর প্রভাব কতটুকু? এই পবিত্র কিতাবের সাথে একজন রসূল পাঠানো ছিল কেন তা বলা হয়েছে এবং এ সূরার শেষের দিকে (আয়াত ৬ এবং ৭) সবচেয়ে খারাপ ও সবচেয়ে ভাল সৃষ্টি এর কথা বর্নিত হয়েছে। আর ৯৯ তম সূরা আল যিলযালের শেষে ক্ষুদ্রতম ভাল ও ক্ষুদ্রতম খারাপ এর কথা বর্নিত হয়েছে।
আহলি কিতাব ও মুশরিক কারা?
যাদের কাছে আগের নবীদের আনা কোন আসমানী কিতাব ছিল, তা যত বিকৃত আকারেই থাক না কেন, তারা তা মেনে চলতো, তাদেরকে বলা হয় আহলি কিতাব৷ আর যারা কোন নবীর অনুসারী ছিল না৷ কোন আসমানী কিতাবও মানতো না তারা মুশরিক৷ কুরআন মজীদের বহু স্থানে আহলি কিতাবদের শির্কের উল্লেখ করা হয়েছে৷ যেমন খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে :
- তারা বলে ,আল্লাহ তিন খোদার একজন ৷” ( আল মায়েদাহ ৭৩ )
- “তারা মসীহকেও খোদা বলে৷ “(আল মায়েদাহ ১৭ )
- “তারা মসীহকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করে৷” (আত তাওবা ৩০ )
আবার ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে : “তারা উযাইরকে আল্লাহর পুত্র বলে” (আত তাওবা ৩০ )
কিন্তু এসব সত্ত্বে কুরআনের কোথাও তাদের জন্য মুশরিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়নি৷ বরং তাদের উল্লেখ করা হয়েছে “আহলি কিতাব” বা “যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিল” শব্দের মাধ্যমে৷ অথবা ইয়াহুদ ও নাসারা শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে৷ কারণ তারা তাওহিদী ধর্ম মানতো, তারপর শিরক করতো৷ বিপরীত পক্ষে অ-আহলি কিতাবদের জন্য পারিভাষিক পর্যায়ে মুশরিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ কারণ তারা শিরককেই আসল ধর্ম গণ্য করতো৷ তাওহীদকে তারা পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করতো৷ এ দু’টি দলের মধ্যকার এ পার্থক্যটা শুধুমাত্র পরিভাষার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, শরীয়াতের বিধানের মধ্যেও এ পার্থক্য ছিল৷ আহলি কিতাবার আল্লাহর নাম নিয়ে যদি কোন হালাল প্রাণীকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ করে তাহলে তা মুসলমানের জন্য হালাল গণ্য করা হয়েছে৷ তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ অন্যদিকে মুশরিকদের যবেহ করা প্রাণীও হালাল নয় এবং তাদের মেয়েদেরকে বিয়ে অনুমতি দেয়া হয়নি৷
যারা কুফরী করেছে–
এখানে কুফরী শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে বর্ণনা করা হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রকার কুফরী দৃষ্টিভংগী এর অন্তরভুক্ত৷ যেমন কেউ এই অর্থে কাফের ছিল যে, সে আদৌ আল্লাহকে মানতো না৷ আবার কেউ আল্লাহকে মানতো ঠিকই কিন্তু তাঁকে একমাত্র মাবুদ বলে মানতো না ৷ বরং আল্লাহর সত্ত্বা ও তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের গুণাবলী ও ক্ষমতায় কোন না কোনভাবে অন্যদেরকে শরীক করে তাদের বন্দেগীও করতো৷ কেউ আল্লাহর একত্ব স্বীকার করতো কিন্তু এ সত্ত্বেও আবার কোন না কোন ধরনের শিরকও করতো৷ কেউ আল্লাহকে মানতো কিন্তু তাঁর নবীদেরকে মানতো না এবং নবীদের মাধ্যমে যে হেদায়াত এসেছিল তাকে মানতে অস্বীকার করতো৷ কেউ এক নবীকে মানতো কিন্তু অন্য নবীকে অস্বীকার করতো৷ মোটকথা, বিভিন্ন ধরনের কুফরীতে লোকেরা লিপ্ত ছিল৷ এখানে আহলি কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের ছিল’ একথা বলার অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে তাহলে কিছু লোক ছিল যারা কুফরীতে লিপ্ত ছিল না৷ বরং এর অর্থ হচ্ছে, কুফরীতে লিপ্ত দু’টি দল ছিল, একটি আহলি কিতাব ও অন্যটি মুশরিক৷
এখানে মিন ( مِنۡ ) শব্দটি কতক বা কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়নি৷ বরং ‘মিন’ এখানে বর্ণনামূলক ৷ যেমন সূরা হজ্জের ৩০ আয়াতে বলা হয়েছে مِنَ الۡاَوۡثَانِ وَ اجۡتَنِبُوۡا قَوۡلَ الزُّوۡرِ অর্থাৎ মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো৷ এর অর্থ এ নয় যে, মূর্তিদের মধ্যে যে অপবিত্রতা আছে তা থেকে দূরে থাকো৷
তেমনি مِنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ এর অর্থ হচ্ছে : যারা কুফরী করে, যারা আহলে কিতাব ও মুশরিকদের দলের অন্তরভুক্ত ৷ এর অর্থ এ নয় যে, এই দু’টি দলের মধ্য থেকে যারা কুফরী করে৷
مُنفَكِّين মানে বিরত বা বিচলিত।
যতক্ষন না তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আসবে—
অর্থাৎ বায়্যিনাহ বা একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে তাদেরকে কুফরীর প্রতিটি গলদ ও সত্য বিরোধী বিষয় বুঝাবে এবং যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে সুস্পষ্ট পদ্ধতিতে সত্য সঠিক পথ তাদের সামনে পেশ করবে, এ ছাড়া এই কুফরীর অবস্থা থেকে বের হবার আর কোন পথ তাদের সামনে ছিল না৷ এর মানে এ নয় যে, এ সুস্পষ্ট প্রমাণটি এসে যাবার পর তারা সবাই কুফরী পরিত্যাগ করবে৷ বরং এর মানে হচ্ছে এই প্রমাণটির অনুপস্থিতিতে তাদের এই অবস্থার মধ্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপরই ছিল না৷ তবে তার আসার পরও তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের কুফরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়৷ এরপর তারা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারবে না যে, আপনি আমাদের হোদায়াতের কোন ব্যবস্থা করেননি৷ এই ধরনের কথা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে৷
- যেমন সুরা নাহলে বলা হয়েছে : সোজা পথ দেখানো আল্লাহরই দায়িত্ব৷” ( ৯ আয়াত )
- সূরা লাইলে বলা হয়েছে : পথ দেখাবার দায়িত্ব আমার৷” (১২ আয়াত
- আমি তোমার প্রতি ঠিক তেমনিভাবে অহী পাঠিয়েছি যেভাবে নূহ ও তারপর নবীদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম। এই রসূলদেরকে সুসংবাদদানকারী ও সতর্ককারী করা হয়েছে যাতে রসূলদের পর লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে৷ ” ( আন নিসা ১৬৩-১৬৪ আয়াত )
- “হে আহলি কিতাব! রসূলদের সিলসিলা দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর প্রকৃত সত্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য তোমাদের কাছে আমার রসূল এসেছে৷ যাতে তোমরা বলতে না পারো আমাদের কাছে না কোন সুসংবাদদানকারী এসেছিল, না এসেছিল কোন সতর্ককারী৷ কাজেই নাও, এখন তোমাদের কাছে সুসংবাদদানকারী এসে গেছে এবং সতর্ককারীও৷” ( আল মায়েদাহ ১৯)
এই বায়্যিনাহ বা সুস্পষ্ট প্রমাণটা কি? এই ব্যাখ্যা ২য় আয়াতে দেওয়া হয়েছে।
বাইয়্যিনাহ- হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা মহৎ, অসাধারন রসূল এবং তাঁর পাঠ করা পবিত্র কিতাব। সুতরাং, বাইয়্যিনাহ দুটি উপাদান দ্বারা গঠিত, বার্তাবাহক এবং বার্তা। এখানে ‘রাসূলুল্লহ’ (আল্লাহর রসূল) না বলে বলা হয়েছে ‘রাসূলুম মিনাল্লহ’ (আল্লহর পক্ষ থেকে আসা), অর্থাৎ এখানে আল্লাহর সাথে সেই রসূলের অসাধারন ও ঘনিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া রাসুল শব্দটিতে একটি তানভীন আছে ফলে শব্দটি হলো রাসুলুন। এর ফলে অনুবাদটি হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একজন মহৎ, অসাধারন রসূল যিনি মানুষকে পাঠ করে শুনান পবিত্র কিতাব। সুতরাং, বাইয়্যিনাহ দুটি উপাদান দ্বারা গঠিত বার্তাবাহক এবং বার্তা। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কিতাব যার মধ্যে হয়েছে নির্দেশনা এবং সেই নির্দেশনা বাস্তবে বাস্তবায়ন করে দেখানো রসূল; এই দুয়ের সমন্বয়েই হয় বায়্যিনাহ (সুস্পষ্ট প্রমান)। নিয়ম নীতি, নির্দেশনা বর্ননা করার জন্য এসেছে কিতাব। সেই কিতাবকে বাস্তবে বাস্তবায়ন করার জন্য এসেছেন মানুষ হিসাবে এসেছেন রসূল। কিতাব রসূলকে গাইড করে এবং রসূল কিতাবকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে একে অপরের সহযোগিতা, সমন্বয়েই হয় সুস্পষ্ট প্রমান, আল বায়্যিনাহ।
ইয়াতলু শব্দটি তিলাওয়াত শব্দ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ পাঠ করা কিন্তু যেকোন কিছু পাঠ করাকে তিলাওয়াত বলা যায় না বরং যে পাঠ পাঠ-দানকারীর সম্পূর্ণ অনুরূপে হবে তাকেই তিলাওয়াত বলা হয়। তাই পরিভাষায় কোরআন পাঠ করাকে তিলাওয়াত বলা হয়। কুরআন নাযিলের ধাপগুলো চিন্তা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। কুরআন লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত রয়েছে সেটা জিব্রাঈল কুরআন রাসূলকে শুনালে এবং রাসূল হুবহু তা তিলাওয়াত করলেন। লওহে মাহফুযে সংরক্ষিত কুরআন অনুরূপ রাসুল তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন এই জন্য ইয়াতলু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
এখানে শুধু ‘সুহুফান’ (কিতাব) বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে সুহুফাম মুতহহারহ (পবিত্র কিতাব)। এই কিতাব যার কাছ থেকে এসেছে তিনি (আল্লাহ) পবিত্র, এর মধ্যে যা আছে তা, সন্দেহাতীত পবিত্র, যেখানে এর মূল কপি রাখা আছে সেই জায়গাটি (লাওহে মাহফুয) পবিত্র ও সুরক্ষিত, যে জাগয়ার মধ্য দিয়ে এটি মুহাম্মাদ (স) এর কাছে নিয়ে আসা হয়েছে সেই জায়গাটি (আসমান) ছিল পবিত্র ও সুরক্ষিত (জীন, শয়তান হতে), যার উপরে এটি অবতীর্ন হয়েছে তিনি পবিত্রতম মানুষ মুহাম্মাদ (স), এবং এটি যে পর্যন্ত থাকবে ততদিন এটি পবিত্র ও অবিকৃত থাকবে কারন স্বয়ং আল্লাহই এর সুরক্ষার ও হিফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই কিতাব পবিত্র। কুরআনে অন্যত্রে এসেছে- “ওটা আছে মর্যাদা সম্পন্ন লিপিসমূহে, যা উন্নত, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লেখকের হাতে লিখিত।” [সূরা আবাসাঃ ১৩–১৬]
আরবীতে কুতব শব্দটি অর্থ আহকাম (আইন) এবং এর দ্বারা বইও বোঝাতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি বইয়ের চেয়ে আইনের জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়। এখানে كُتُب থেকে দ্বীনের হুকুম-আহকাম বা বিধান অর্থ নেওয়া হয়েছে। যেমন- كتب عليكم الصيام (সূরা বাকারাহ ১৮৩), كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ۖ (সূরা বাকারাহ ১৭৮) আয়াতগুলোতে কুতিবা শব্দ উল্লেখ করে হুকুম/আহকাম, বিধান জারী করা হয়েছে। এই হুকুম/আহকাম, বিধান মানে শুধু যে হালাম-হারামের উল্লেখ বা কোনটা করা যাবে এটা কোন কাজ করা যাবে না এটা না। এখানে কুতব এর অর্থ ব্যাপক। পরের শব্দ قَیِّمَۃٌ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সুদৃঢ় রূপে প্রতিষ্ঠিত, সরল, সুশৃংখল। অর্থাৎ রাসূল যে বিধান নিয়ে এসেছে তা সঠিক ও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিতে এতে বিন্দুমাত্র বক্রতা বা জড়তা নেই।
অর্থাৎ, আহলে কিতাব নবী (সাঃ)-এর আগমনের পূর্বেই তারা একতাবদ্ধ ছিল। পরিশেষে তাঁর আগমন ঘটল, অতঃপর তারা দলে দলে বিভক্ত হল। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক ঈমান আনল। কিন্তু অধিকাংশ লোক ঈমান হতে বঞ্চিত থেকে গেল। নবী (সাঃ)-এর আগমন এবং রিসালাতকে দলীল বা সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে অভিহিত করার রহস্য এই যে, তাঁর সত্যতা সুস্পষ্ট ছিল; যা অস্বীকার করার কোন অবকাশ ছিল না। কিন্তু তারা (ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানরা) নবী (সাঃ)-কে কেবল হিংসা ও হঠকারিতা বশে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল। এই কারণেই দলে দলে যারা বিভক্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ‘আহলে কিতাবে’র নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অন্যান্যরাও এ কাজে পতিত হয়েছিল। যেহেতু এরা ছিল শিক্ষিত লোক এবং নবী (সাঃ)-এর আগমন ও গুণাবলীর উল্লেখ তাদের কিতাবেও বিদ্যমান ছিল।
এখানে তিনটা নির্দেশের কথা বলা হয়েছে– আল্লাহর ইবাদত, সালাত কায়েম এবং যাকাত প্রদান। আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে মুখলিস গুণাবলীর কথা সংযুক্ত করা হয়েছে এবং বলা তাদের বলা হয়েছে হানিফা।
মুখলিসুন এসেছে ইখলাস থেকে, যার অর্থ একান্ত নিবেদিত, আন্তরিক, পরিষ্কার, পবিত্র হওয়া। কুরআন বিভিন্ন জাগায় ইবাদত বা আল্লাহর ডাকার কথা যখনই বলা হয়েছে তখনই উল্লেখ করা হয়েছে এখলাসের কথা বা একনিষ্ঠভাবে ডাকার কথা। আল্লাহ তা’আলাকে এমনভাবে ডাক, যেন ইবাদাত খাঁটিভাবে তারই জন্য হয়; এতে যেন অন্য কারো অংশীদারিত্ব না থাকে; এমন কি গোপন শির্ক অর্থাৎ লোক দেখানো ও নাম-যশের উদ্দেশ্য থেকেও পবিত্র হওয়া চাই। এতে বোঝা গেল যে, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উভয় অবস্থাকেই শরীআতের বিধান অনুযায়ী সংশোধন করা অবশ্য কর্তব্য। এবং আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো মুখলিস শব্দ ব্যবহারের সময় অনেকাংশে (اُمِرۡتُ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকার, তাঁর ইবাদত করার আদেশ দেওয়া হচ্ছে। সূরা আ’রাফ ২৯ নং আয়াত, সূরা মু’মিন ৬৫, সূরা আয-যুমার : ১১।
মুখলিস বা একনিষ্ঠ কিভাবে হতে হবে সেটা উদাহরণের সাহায্যে কুরআন বিভিন্ন জায়গা উল্লেখ করা হয়েছে- মনে করুন, নৌকা ভ্রমণে সময় বা সাগরে মাঝে প্রবল ঝড়ের কবলে আপনি পড়লেন। আপনি বুঝতে পারলেন আপনি আবরুদ্ধ হয়ে গেছেন। ঠিক সেই মুহুর্তে আল্লাহকে আপনি কতটুক আন্তরিকতা নিয়ে ডাকবে? কতটুক নিষ্ঠার সাথে বাঁচার আকুতি জানাবেন? হ্যাঁ, ঠিক সেইভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার আকুতি নিয়ে আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ডাকার কথা বলা হয়েছে। কুরআনে উল্লেখ আছে- “তিনিই তোমাদেরকে জলে-স্থলে ভ্রমণ করান। এমনকি তোমরা যখন নৌযানে আরোহন কর এবং সেগুলো আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে বেরিয়ে এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়, তারপর যখন দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে এবং চারদিক থেকে উত্তাল তরঙ্গমালা ধেয়ে আসে, আর তারা নিশ্চিত ধারণা করে যে, এবার তারা ঘেরাও হয়ে পড়েছে, তখন তারা আল্লাহ্কে তার জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে ডেকে বলেঃ আপনি আমাদেরকে এ থেকে বাঁচালে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।” (সূরা ইউনুস ২২) একই ভাবে আরো উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সূরা আনকাবুত ৬৫, সূরা লুকমান ৩২।
حَنِيف শব্দের অর্থ হল ঝুঁকে যাওয়া, কোন একটির প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া। حُنَفَاء তারই বহুবচন শব্দ। অর্থাৎ, তারা শিরক থেকে তাওহীদের প্রতি এবং সমস্ত দ্বীন-ধর্ম হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে কেবলমাত্র দ্বীনে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে ও একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত – করতে আদিষ্ট হয়েছিল; যেমন ইবরাহীম (সাঃ) করেছিলেন। – আমি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি যিনি আকাশমন্ডলী আর পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আন’আম ৭৯)
আরো উল্লেখ আছে- ইবরাহীম ইয়াহূদীও ছিল না, নাসারাও ছিল না; বরং সে ছিলো হানিফ তথা একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা। সূরাহ আলু ইমরান : ৬৭; সূরাহ বাক্বারাহ : ১৩৫; সূরাহ আন’আম : ১৬১; সূরাহ নাহল : ১২৩
সহীহ একটি হাদীছে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহ বলেন, “আমি আমার সকল বান্দাদেরকে হানিফ তথা একনিষ্ঠ (মুসলিম) হিসেবে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদের নিকট শয়তান এসে তাদেরকে দ্বীন হতে সরিয়ে দেয়। আমি যে সমস্ত জিনিস তাদের জন্য বৈধ করেছিলাম সে তা হারাম করে দেয়। অধিকন্তু সে তাদেরকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শিরক করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে, যে বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ নাযিল করিনি।” সহিহ মুসলিম ৬৯৪৩
لِیَعۡبُدُوا اللّٰهَ – আল্লাহর ইবাদত
ইবাদাত আসলে ২ টি কাজের সংমিশ্রন। ১। উপাসনা ও ২। দাসত্ব। যেকোন একটি অনুপস্থিত থাকলে ইবাদাত পরিপূর্ন হয় না। আনুষ্ঠানিকভাবে আল্লাহর উপাসনা করা ও উপাসনা বাদে অন্য সব সময়ে আল্লাহর দাসত্ব করাই হলো আল্লাহর ইবাদাত করা। অর্থাৎ শুধু আল্লাহর উপাসনা করলেই হবে না, তাঁর দাস হতে হবে। অন্য সকল মনিব বা মালিক এর প্রতি দাস স্বেচ্ছায়, আনন্দ সহকারে থাকে না কিন্তু আল্লাহ অন্য ধরনের মনিব বা মালিক, তিনি মানুষের মত নন। তাই তাঁর কাছে স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরন করতে হবে, কারন তিনি আমাদের ভাল চান।
وَ یُقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوا الزَّکٰوۃَ – সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্ৰদান করে।
ইসলামী শরিয়তে পাঁচটি মূল বুনিয়াদি রুকন বা স্তম্ভের মধ্যে কালেমার পর সালাত আর তৃতীয় ভিত্তি হলো যাকাত। যাকাত একটি ইবাদত যেমন সালাত একটি ইবাদত। সালাত অস্বীকার করলে যেমন ঈমান থাকবে না তেমনি যাকাত অস্বীকারে ঈমান থাকবেনা। ধনাঢ্য লোকদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভে নামায ও যাকাতের কোন বিকল্প নেই। মানুষ আল্লাহর প্রিয় হওয়ার জন্য দুটি জিনিস জরুরী।
১. আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক জোড়া।
২. বান্দার সাথে সুসম্পর্ক গড়া।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হয় সালাত মাধ্যমে। আর বান্দার সঙ্গে সম্পর্ক হয় দানের মাধ্যমে, যাকাতের মাধ্যমে। এ কারণে কুরআনে কারীমের বত্রিশ জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে আটাশ জায়গায় নামায ও যাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে।
وَ ذٰلِکَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَۃِ – আর এটাই সঠিক দ্বীন।
القَيِّمَة শব্দটি উহ্য মাউসূফের সিফাত (বিশেষ্যের বিশেষণ)। আসল হল, دِينُ المِلَّة القَيِّمَة أو الأمَّة القَيِّمَة অর্থাৎ, এটাই সঠিক ও সরল বা মধ্যপন্থী মিল্লত বা উম্মতের ধর্ম। অধিকাংশ উলামাগণ এই আয়াত থেকে প্রমাণ করেছেন যে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। (ইবনে কাসীর)
৩য় আয়াতে ‘কয়্যিমাহ’ (সোজাভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত) আসার পর আবার ৫ম আয়াতেও আবার ‘কয়্যিমাহ’ এসেছে, অর্থাৎ এভাবে বলা যায় যে, ৩য় আয়াতের ব্যাখ্যা আকারে বর্ননা হলো ৫ম আয়াত।
এটাই আসল, সত্য দ্বীন। এখানে সুন্দরভাবে দ্বীনের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই দ্বীনের প্রতিই খালেসভাবে, আন্তরিকতার সাথে থাকার জন্য বলা হয়েছে। কিছু অংশ মানলাম কিছু অংশ মানলাম না এমন না। যেমনটি করতো ও করে আহলে কিতাবরা। এর সাথে সাথে মূল বিষয় হিসাবে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত দেয়ার কথা এসেছে। সুতরাং অন্তরে দৃড় বিশ্বাস রাখার পর তা মুখে স্বীকার করা, বলা ও কাজে পরিনত করাই হলো দ্বীন। সুতরাং অন্তরের ইবাদাত, শারিরীক ইবাদাত (সালাত) ও আর্থিক ইবাদাত (যাকাত); এগুলোর সমন্বয়ই হলো সঠিক জীবন বিধান, এটাই সঠিক অবস্থান।
এখানে কুফরী মানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেনে নিতে অস্বীকার করা৷ অর্থাৎ মুশরিক ও আহলি কিতাবদের মধ্য থেকে যারা এই রসূলের নবুওয়াত লাভের পর তাঁকে মানেনি৷ অথচ তাঁর অস্তিত্বই একটি সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল প্রমাণ৷ তিনি সম্পূর্ণ ও নিভুল লিপি সম্বলিত মত পবিত্র সহীফা পাঠ করে তাদেরকে শুনাচ্ছেন৷ এ ধরনের লোকদের পরিণাম তাই হবে যা সামনের দিকে বর্ণনা করা হচ্ছে৷ অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি আর নেই৷ এমন কি তারা পশুরও অধম৷ কারণ পশুর বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি নেই৷ কিন্তু এরা বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তা ও কর্মশক্তি সত্ত্বেও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়৷
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে ঈমান (আভ্যন্তরীণ বিষয়), পরে উল্লেখ করা হয়েছে সৎকাজ (বাহ্যিক বিষয়)। যেভাবে আদেশ করা হয়েছে ৫ নং আয়াতে, ইখলাস (আভ্যন্তরীণ বিষয়) এবং সালাত ও যাকাত (বাহ্যিক বিষয়)।
যারা আন্তরিকভাবে ঈমান আনে এবং যারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আমল করে, তারাই সৃষ্টির মধ্যে সবার থেকে উত্তম ও উৎকৃষ্টতম সৃষ্টি। তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবার এমনকি ফেরেশতাদেরও সেরা ৷ কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখে না৷ আর মানুষ এই নাফরমানি করার স্বাধীন ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে ৷
উৎকৃষ্ট সৃষ্টির বর্ননা আল্লাহ নিকৃষ্ট সৃষ্টির সমান দেন নি, বরং বেশি দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেকে সম্পৃক্ত করে বর্ননা দিয়েছেন, কিন্তু আয়াত ৭ এ কিন্তু আল্লাহ নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি কারন তিনি তাদের পছন্দ করেন না, দূরে থাকতে চান তাদের থেকে, যেমন ঘটেছে আগের ৪র্থ আয়াতের ক্ষেত্রেও। এই ৮ম আয়াতে আল্লাহ ৭ম আয়াতের চেয়ে বেশি শব্দে তাদের বর্ননা দিয়েছেন। তাদের প্রতি পুরস্কার হলো জান্নাত, এবং এই জান্নাত তাদের রবের কাছ থেকে পুরস্কার হিসাবে আসবে। এখানেই ‘রব্বিহিম’ (তাদের রব) বলার মাধ্যমে আল্লাহ নেককারদেরকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করে নিলেন কারন তারা দুনিয়ায় নিজেদেরকে আল্লাহর সাথে সুন্দরভাবে সম্পৃক্ত করে নিত। আল্লাহ তাদের পুরস্কার হিসাবে চিরস্থায়ী জান্নাত দিবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্না প্রবাহিত হবে।
বাগান, ঝর্না, পানি, গাছ এগুলো জান্নাতের সবচেয়ে বহুল বর্নিত নিয়ামত। মানুষ আসলেই এগুলো খুব পছন্দ করে। শুধু তৎকালীন মরুর বুকের আরবেরা নয় বর্তমান যুগের মানুষেরাও এগুলো পছন্দ করে, আগামীতেও করবে। ডিলাক্স, লাক্সারীয়াস সুবিধার মূল কেন্দ্রেই থাকে এগুলো। সমুদ্র, বীচ, নদী সাইড প্রপার্টি, সুইমিং পুল, ঝরনা, সবুজ লন, বাগান এগুলো সবই পানি ও গাছের সাথে সম্পর্কিত যা জান্নাতের দুই মূল উপাদান। অর্থাৎ আমাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই আল্লাহ পুরস্কার দিবেন তবে মাত্রা ও তার সৌন্দর্য্য হবে অকল্পনীয়।
এবং সেই জান্নাতের সাথে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ যেমন ঐসব নেককার, যারা শেষ্ঠ সৃষ্টি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন তেমনি আল্লাহর পুরস্কার, জান্নাতে চিরস্থায়িত্ব, আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়ে নেককাররাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবে। তারা তাদের মালিককে যথাযথভাবেই ভয়, শ্রদ্ধা করেছে, কারন ভয়হীন ভালোবাসা মানুষকে লাগামহীন, বেপরোয়া করে তোলে।
তাদের ঈমান, আনুগত্য এবং সৎকর্মের কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হল সব থেকে বড় জিনিস। মহান আল্লাহ বলেন, ( وَرِضْوَٰنٌ مِّنَ ٱللَّهِ أَكْبَرُ) (সূরা তাওবাহ ৭২আয়াত)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা জান্নাতীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, হে জান্নাতীগণ! তখন তারা জওয়াব দেবে, হে আমাদের রব! আমরা উপস্থিত এবং আপনার আনুগত্যের জন্যে প্রস্তুত। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা জওয়াব দেবে, হে আমাদের রব! এখনও সন্তুষ্ট না হওয়ার কি সম্ভাবনা? আপনি তো আমাদেরকে এত সব দিয়েছেন, যা অন্য কোন সৃষ্টি পায়নি। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদেরকে আরও উত্তম নেয়ামত দিচ্ছি। আমি তোমাদের প্রতি আমার সস্তুষ্টি নাযিল করছি। অতঃপর কখনও তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না।” [বুখারী: ৬৫৪৯, ৭৫১৮, মুসলিম: ২৮২৯]
সুতরাং সূরাটির মূল কথা হিসাবে বলা যায়, কিতাব ও রসূলের সমন্বয়ে যে আল বায়্যিনাহ সেটা মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। সবচেয়ে খারাপ সৃষ্টি ও সবচেয়ে ভাল সৃষ্টি। এই দুই দলের পরিনতিও আলাদা হবে। একদল হবে জাহান্নামী; তাদের উপরে থাকবে আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং অপর দল হবে জান্নাতী, তাদের উপরে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবে।
উৎকৃষ্ট সৃষ্টির বর্ননা আল্লাহ নিকৃষ্ট সৃষ্টির সমান দেন নি, বরং বেশি দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেকে সম্পৃক্ত করে বর্ননা দিয়েছেন, কিন্তু আয়াত ৭ এ কিন্তু আল্লাহ নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি কারন তিনি তাদের পছন্দ করেন না, দূরে থাকতে চান তাদের থেকে, যেমন ঘটেছে আগের ৪র্থ আয়াতের ক্ষেত্রেও। এই ৮ম আয়াতে আল্লাহ ৭ম আয়াতের চেয়ে বেশি শব্দে তাদের বর্ননা দিয়েছেন। তাদের প্রতি পুরস্কার হলো জান্নাত, এবং এই জান্নাত তাদের রবের কাছ থেকে পুরস্কার হিসাবে আসবে। এখানেই ‘রব্বিহিম’ (তাদের রব) বলার মাধ্যমে আল্লাহ নেককারদেরকে নিজের সাথে সম্পৃক্ত করে নিলেন কারন তারা দুনিয়ায় নিজেদেরকে আল্লাহর সাথে সুন্দরভাবে সম্পৃক্ত করে নিত। আল্লাহ তাদের পুরস্কার হিসাবে চিরস্থায়ী জান্নাত দিবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্না প্রবাহিত হবে।
বাগান, ঝর্না, পানি, গাছ এগুলো জান্নাতের সবচেয়ে বহুল বর্নিত নিয়ামত। মানুষ আসলেই এগুলো খুব পছন্দ করে। শুধু তৎকালীন মরুর বুকের আরবেরা নয় বর্তমান যুগের মানুষেরাও এগুলো পছন্দ করে, আগামীতেও করবে। ডিলাক্স, লাক্সারীয়াস সুবিধার মূল কেন্দ্রেই থাকে এগুলো। সমুদ্র, বীচ, নদী সাইড প্রপার্টি, সুইমিং পুল, ঝরনা, সবুজ লন, বাগান এগুলো সবই পানি ও গাছের সাথে সম্পর্কিত যা জান্নাতের দুই মূল উপাদান। অর্থাৎ আমাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই আল্লাহ পুরস্কার দিবেন তবে মাত্রা ও তার সৌন্দর্য্য হবে অকল্পনীয়।
এবং সেই জান্নাতের সাথে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ যেমন ঐসব নেককার, যারা শেষ্ঠ সৃষ্টি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন তেমনি আল্লাহর পুরস্কার, জান্নাতে চিরস্থায়িত্ব, আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়ে নেককাররাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবে। তারা তাদের মালিককে যথাযথভাবেই ভয়, শ্রদ্ধা করেছে, কারন ভয়হীন ভালোবাসা মানুষকে লাগামহীন, বেপরোয়া করে তোলে।
তাদের ঈমান, আনুগত্য এবং সৎকর্মের কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হল সব থেকে বড় জিনিস। মহান আল্লাহ বলেন, ( وَرِضْوَٰنٌ مِّنَ ٱللَّهِ أَكْبَرُ) (সূরা তাওবাহ ৭২আয়াত)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা জান্নাতীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, হে জান্নাতীগণ! তখন তারা জওয়াব দেবে, হে আমাদের রব! আমরা উপস্থিত এবং আপনার আনুগত্যের জন্যে প্রস্তুত। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা জওয়াব দেবে, হে আমাদের রব! এখনও সন্তুষ্ট না হওয়ার কি সম্ভাবনা? আপনি তো আমাদেরকে এত সব দিয়েছেন, যা অন্য কোন সৃষ্টি পায়নি। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমাদেরকে আরও উত্তম নেয়ামত দিচ্ছি। আমি তোমাদের প্রতি আমার সস্তুষ্টি নাযিল করছি। অতঃপর কখনও তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না।” [বুখারী: ৬৫৪৯, ৭৫১৮, মুসলিম: ২৮২৯]
সুতরাং সূরাটির মূল কথা হিসাবে বলা যায়, কিতাব ও রসূলের সমন্বয়ে যে আল বায়্যিনাহ সেটা মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। সবচেয়ে খারাপ সৃষ্টি ও সবচেয়ে ভাল সৃষ্টি। এই দুই দলের পরিনতিও আলাদা হবে। একদল হবে জাহান্নামী; তাদের উপরে থাকবে আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং অপর দল হবে জান্নাতী, তাদের উপরে থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবে।
ফুটনোট
* আলোচ্য সূরার আলোকে দ্বীনুল কায়্যিমাহ বা সঠিক ধর্মের উপাদান তিনটি- ইবাদাত, সালাত, যাকাত।
* ইবাদাত আসলে ২ টি কাজের সংমিশ্রন। ১। উপাসনা ও ২। দাসত্ব।
* বায়িন্যাহ বা সুস্পষ্ঠ প্রমাণ হলো দুইটি বিষয়ের সমন্বয়ে- কিতাব ও রাসূল।
* আল্লাহ শুধু কিতাবের দিক নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন নাই বরং রসূলকে দিয়ে তাঁর পরিপূর্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলাম শুধু যৌক্তিক থিওরী নয় সাথে দৃশ্যমান, প্রাক্টিকাল বাস্তবায়নও করে দেখানো শিক্ষা দেয়। ইসলামী ফিলোসফি অনুযায়ী একটি থিওরী খুব ভাল হতে পারে কিন্তু তা যদি বাস্তবায়নযোগ্য না হয়, কথা ও কাজের মিল যদি না থাকে তাহলে তা শেষ পর্যন্ত ভাল বা আদর্শ বলা যাবে না।
যদি শুধু রসূল আসেন, কিন্তু কিতাব তাঁর উপর অবতীর্ন না হয় তাহলে কেউ কেউ বলতে পারে, আমাদের আশেপাশে অনেক ভাল মানুষ আছে কিন্তু আমরা কীভাবে চলবো তা তো জানিনা। আমাদের পাকড়াও করা যাবে না। আবার যদি এমন হয় শুধু কিতাব এলো কিন্তু কোন রসূল এলেন না তাহলেও মানুষ কুযুক্তি দিতে পারে, এই কিতাব আসলে অনেক কঠিন, আমাদের মত মানুষের পক্ষে এটি সব মেনে চলা সম্ভব না। আমাদের পাকড়াও করা যাবে না। কিন্তু যখন এই কিতাব ও রসূল একই সাথে আসেন তখন আর বলার মত যৌক্তিক কোন অযুহাত থাকে না।
* কিতাব ও রসূলের সমন্বয়ে যে আল বায়্যিনাহ সেটা মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। সবচেয়ে খারাপ সৃষ্টি (শাররুল বারিয়্যাহ) ও সবচেয়ে ভাল সৃষ্টি (খায়রুল বারিয়াহ )।
* শাররুল বারিয়্যাহ এর প্রতিদান হলো- তারা দোযখের আগুনের মধ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। খায়রুল বারিয়াহ এর প্রতিদান হলো- স্থায়ী জান্নাত, যার নিচে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তার প্রতি সস্তুষ্ট।
* রাসূলের কাজ হলো- তিনি কিতাব সমূহ তিলাওয়াত করে শুনান।
* কিতাবগুলোর পরিচয় দুইটি- ১. সুহুফাম মুতহহারহ বা পবিত্র কিতাব ২. যাতে আছে সঠিক বিধিবদ্ধ বিধান
* শেষ আয়াতে জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার সূত্র বলে দেওয়া হয়েছে-এটি তার জন্য, যে তার রবকে ভয় করে।
* আকিমুস সালাত- নামাজ প্রতিষ্ঠার কাজ তিনভাবে করা যায়-
- নিজে জামায়াতের সাথে ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। খুশু-খুজু সহ নামাজের হক আদায় করে পড়া।
- পরিবার ও নিকটজনকে নামাজের তাকীদ দেওয়া
- নামাজ শিক্ষা সমাজে বাস্তবায়ন করা
* প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর থাকলে যাকাত দেওয়া ফরজ হয়ে যায়। যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন বা ভিত্তি। তাই আমাদের উচিত যাকাত ফরজ হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখা এবং যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা।