Notes 7: Sura Qariyah

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ

সূরা আল ক্বারিয়াহ

কুরআন মাজীদের ১০১ তম সূরা। এতে রয়েছে ১১টি আয়াত এবং ১টি রুকু। সূরাটি মাক্কী সূরা। ক্বারিয়াহ অর্থ মহাসংকট।

নামকরণ :

প্রথম শব্দ ( الْقَارِعَةُ) কে এর নাম গণ্য করা হয়েছে। এটা কেবল নামই নয় বরং এর বক্তব্য বিষয়ের শিরোনামও । কারণ এর মধ্যে শুধু কিয়ামতের কথাই বলা হয়েছে।

নাযিলের সময় – কাল

এর মক্কী হবার ব্যাপারে সবাই একমত। বরং এর বক্তব্য বিষয় থেকে প্রকাশ হয় , এটিও মক্কা মু’ আযযমার প্রথম যুগে নাযিল হয়।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে কিয়ামত ও আখেরাত । সর্বপ্রথম লোকদেরকে একটি মহাদুর্ঘটনা বা মহাবিপদ! বলে আতংকিত করে দেয়া হেয়েছে , কি সেই মহাদুর্ঘটনা ? তুমি কী জানো সেই মহা দুর্ঘটনাটি কী ? এভাবে শ্রোতাদেরকে একটি ভয়াবহ ঘটনা অনুষ্ঠিত হবার খবর শোনার জন্য প্রস্তুত করার পর দু’টি বাক্যে তাদের সামনে কিয়ামতের নকশা এঁকে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে , সেদিন লোকেরা আতংকগ্রস্ত হয়ে এমনভাবে চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে যেমন প্রদীপের আলোর চারদিকে পতংগরা নির্লিপ্তভাবে ছুটাছুটি করতে থাকে। পাহাড়গুলো সমূলে উৎপাটিত হয়ে স্থানচ্যূত হবে । তাদের বাঁধন থাকবে না। তারা তখন হয়ে যাবে ধূনা পশমের মতো। তারপর বলা হয়েছে , আখেরাতে লোকদের কাজের হিসেব নিকেশ করার জন্য যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে তখন কার সৎ কাজ তার অসৎকাজের চাইতে ওজনে ভারী এবং কার সৎকাজ তার অসৎকাজের চাইতে ওজনে হালকা , এরি , ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধরনের লোকেরা আরামের ও সুখের জীবন লাভ করে আনন্দিত হবে। আর দ্বিতীয় ধরনের লোকদেরকে এমন গভীর গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হবে যেগুলো থাকবে শুধু আগুনে ভরা।

এখানে একথাটিও সামনে রাখতে হবে যে , এ সূরায় কিয়ামতের প্রথম পর্যায় থেকে নিয়ে শেষ পর্যায় পর্যন্ত পুরো আখেরাতের আলোচনা একসাথে করা হচ্ছে৷

আগের সূরা ও পরের সূরার সাথে সম্পর্কঃ

৯৯-১০২ এই ৪ টি সূরায় আখিরাত ও দুনিয়ার কথা পরপর এসেছে। ৯৯ তম সূরা আল যিলযালে আখিরাতের কথা ১০০ তম সূরা আল আদিয়াতে দুনিয়া বিষয়ক। তেমনি ১০১ তম সূরা আল ক্বরিয়াহ  তে আবার আখিরাতের কথা এবং ১০২ তম সূরা আত তাকাসুর আবার দুনিয়া বিষয়ক। আল্লাহ এভাবে আখিরাত, দুনিয়া, আবার আখিরাত, আবার দুনিয়া এর বিষয় নিয়ে এসে মানুষকে বারবার সাবধান করেছেন এবং দুনিয়ার সাথে যে আখিরাত অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত তা বোঝাতে চেয়েছেন।

এছাড়া ৯৯ নং সূরা আল যিলযাল এ মানুষ উত্থিত হবে ও কর্মকান্ড দেখানো হবে তা বলা হয়েছে। ১০০ নং সূরা আদিয়াত এ মানুষের কর্মকান্ডের পাশাপাশি মনের লুকায়িত উদ্দেশ্যও চিন্তা প্রকাশিত হবে তা বলা হয়েছে। যেহেতু সকল কর্মকান্ড ও চিন্তা প্রকাশিত হবে তাই এর পরের বিষয় হলো বিচার। সেই চুলচেরা বিচার এর কথাই উঠে এসেছে ১০১ নং সূরা আল ক্বরিয়াহ তে। সূরা ক্বারিয়াহে নেকের পাল্লা হালকা অথবা ভারী অনুযায়ী প্রতিদানের কথা উল্লেখ আছে।

 

কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে “কারি’আহ” এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, মহাবিপদ। কারা’আ মানে কোন জিনিসকে কোন জিনিসের ওপর এমন জোরে মারা যার ফলে তা থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়। এই শাব্দিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভয়াবহ দুৰ্ঘটনা ও বড় রকমের মারাত্মক বিপদের ক্ষেত্রে “কারি’আহ” শব্দ বলা হয়ে থাকে। এখানে “আল-কারি’আহ” শব্দটি কিয়ামতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার সূরা আল-হাক্কায় কিয়ামতকে এই শব্দটি দিয়েই চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পূর্বে কিয়ামতের বিভিন্ন নাম উল্লিখিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপঃ الحاقَّة (হাক্ক্বাহ), الطَّامَّة (মহাসংকট), الصَّاخَّة (ধ্বংস/ধ্বনি),  الغَاشِيَة (সমাচ্ছন্নকারী), السَّاعَة (মহাকাল),

الوَاقِعَة (সংঘটন) প্রভৃতি।

কুরআনের মূল শব্দ হচ্ছে “কারি’আহ” এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, মহাবিপদ। কারা’আ মানে কোন জিনিসকে কোন জিনিসের ওপর এমন জোরে মারা যার ফলে তা থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়। এই শাব্দিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভয়াবহ দুৰ্ঘটনা ও বড় রকমের মারাত্মক বিপদের ক্ষেত্রে “কারি’আহ” শব্দ বলা হয়ে থাকে। এখানে “আল-কারি’আহ” শব্দটি কিয়ামতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আবার সূরা আল-হাক্কায় কিয়ামতকে এই শব্দটি দিয়েই চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পূর্বে কিয়ামতের বিভিন্ন নাম উল্লিখিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপঃ الحاقَّة (হাক্ক্বাহ), الطَّامَّة (মহাসংকট), الصَّاخَّة (ধ্বংস/ধ্বনি),  الغَاشِيَة (সমাচ্ছন্নকারী), السَّاعَة (মহাকাল),

الوَاقِعَة (সংঘটন) প্রভৃতি।

শ্রোতাদেরকে সজাগ ও সতর্ক করে দেয়ার জন্য পরপর দুটি প্রশ্ন করা হয়েছে৷ যাতে করে তারা বিষয়টির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে এবং পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পরবর্তী বক্তব্য শ্রবণ করে৷ ঠিক একইভাবে সূরা হাক্কায় কিয়ামতের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন-

وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا الۡقَارِعَۃُ এর ব্যাখ্যাঃ ক্বারিয়াহ’র হাকিকত এবং মৌলত্ব সম্পর্কে আপনার কোনো ইলম নেই। কেননা তাঁর কঠিনতা এত বেশী যে, তথায় কারো না ধারণা পৌঁছতে পারে, না কোনো চিন্তা পৌঁছতে পারে এমনকি তা বুঝাও মুশকিল। যতটুকু-ই আপনি ধারণা করেন না কেন- তা আপনার ধারণার চেয়েও কঠিনতর। এ আয়াত দ্বারা যেন আল্লাহ তা’য়ালা বলতে চাচ্ছেন যে, সে ক্বারিআহ’র তুলনায় দুনিয়ার ক্বারিআহ কিছুই না। পরকালের আগুনের তুলনায় দুনিয়ার আগুন কিছুই না।

অর্থাৎ মানুষ সেদিনের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিক্ষিপ্ততা, আনা-গোনা ইত্যাদিতে উদ্ভ্রান্তের মত থাকবে। মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পতঙ্গ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল”। [সূরা আল-কামার: ৭] আগুন জ্বালানোর পর পতংগ যেমন দিক-বিদিক থেকে হন্য হয়ে আগুনের দিকে ছুটে আসে সেদিন মানুষ তেমনিভাবে হাশরের মাঠের দিকে ছুটে আসবে। এখানে আল্লাহ মানুষ বোঝাতে ‘নাস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘ইনসান’ শব্দটি নয়। নাস অর্থ অনেক মানুষ বোঝায় যা এই দৃশ্য ও প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন; কারন তখন সবাই এলোমেলোভাবে ছুটতে থাকবে।

 

الۡفَرَاشِ বলা হয় সে কদ্রকায় পাখিকুলকে, যেগুলো অগ্নির চতুর্দিকে ঘুরতে কে আমাদের দেশে সেগুলোকে পঙ্গপাল বলা হয়। আর مَبثُوث মানে হল বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ পঙ্গপাল কোনে একটি দিকে থাকে না, চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছন্ন হয়ে। উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন মানুষের অবস্থাটিকে পতঙ্গকুলের অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। কিয়ামতের দিনও মানুষ কঠিন বিপদ ও আত্মচিন্তায় দিশাহারা হয়ে ছুটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে । তাদের এ অবস্থাটিকেই পতঙ্গকুলের অবস্থা দ্বারা বুঝানো হয়েছে ।

عِهن সেই পশমকে বলা হয় যা নানান রঙে রঞ্জিত হয়। مَنفُوش  অর্থ হল ধূনিত।

কিয়ামতের দিন পাহাড়গুলোর অবস্থা বুঝিয়েছেন! অতএব, সেদিন পাহাড়ের যদি এ অবস্থা হয় তাহলে মানুষের কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয় । চরম ধ্বংস সে ব্যক্তিদের জন্য যারা এত সুন্দর করে বুঝানোর পরও সঠিক পথে আসছে না।

মহাপ্রলয়ের দিন পাহাড়ের বিভিন্ন অবস্থা : কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতের দ্বারা বুঝা যায় যে, মহাপ্রলয়ের দিনে পাহাড়ের বিভিন্ন অবস্থা এবং রূপ হবে-

ক. টুকরা টুকরা হবে। যেমন বলা হয়েছে-  وَّ حُمِلَتِ الۡاَرۡضُ وَ الۡجِبَالُ فَدُکَّتَا دَکَّۃً وَّاحِدَۃً  (সূরা হাক্কাহ ১৪)

খ. বিকষিপত বালকানুপের ন্যায় । যেমন বলা হয়েছে-  وَ کَانَتِ الۡجِبَالُ کَثِیۡبًا مَّهِیۡلًا  (সূরা মুযযাম্মিল ১৪)

গ. ধুনা পশমের ন্যায় হবে । যেমন- وَ تَکُوۡنُ الۡجِبَالُ کَالۡعِهۡنِ الۡمَنۡفُوۡشِ (সূরা ক্বারিআহ ৫)

ঘ. মরীচিকায় পরিণত হবে৷ যেমন-  وَّ سُیِّرَتِ الۡجِبَالُ فَکَانَتۡ سَرَابًا (সূরা নাবা ২০)

এ পর্যন্ত কিয়ামতের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা চলেছে৷ অর্থাৎ যখন মহাদুর্ঘটনা ঘটে যাবে ৷ আর এর ফলে সারা দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, লোকেরা আতংকগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে যেমন আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া পতংগরা চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ৷ পাহাড়গুলো রং বেরঙের ধূনা পশমের মতো উড়তে থাকবে ৷ পাহাড়গুলোর রং বিভিন্ন হওয়ার কারণে আসলে তাদেরকে রং বেরঙের পশমের সাথে তুলনা করা হয়েছে৷

এখান থেকে কেয়ামতের দ্বিতীয় পর্যায় আলোচনা শুরু হয়েছে৷ লোকেরা পূর্নবার জীবিত হয়ে আল্লাহ আদালতে হাযির হবার পর থেকে এই পর্যায়টি শুরু৷

মূলে মাওয়াযীন ( مَوَازِين) ব্যবহার করা হয়েছে৷ এ শব্দটি মাওযূন ( مَوزُون)এর বহুবচন হতে পারে৷ আবার মীযান ( مِيزَان) এরও বহুবচন হতে পারে৷ যদি এটি মাওযুনের বহুবচন হয়ে তাহলে ” মাওয়াযীন ” অর্থ হবে এমন ধরনের কর্মকাণ্ড , আল্লাহর দৃষ্টিতে যার কোন ওজন আছে এবং যা তাঁর কাছে কোন ধরনের মর্যাদালাভের যোগ্যতা রাখে৷ আর যদি একে মীযানের বহুবচন গণ্য করা হয তাহলে মাওয়াযীন অর্থ হবে দাঁড়িপাল্লার পাল্লা৷ প্রথম অবস্থায় মাওয়াযীনের ভারী বা হালকা হবার মানে হবে অসৎকর্মের মোকাবিলায় সৎকর্মের ভারী বা হালকা হওয়া ৷ কারণ আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবলমাত্র সৎকাজই ভারী ও মূল্যবান৷ দ্বিতীয় অবস্থায় মাওয়াযীনের ভারী হাবার মানে হয় মহান আল্লাহর আদালতে নেকীর পাল্লা পাপের পাল্লার তুলনায় বেশী ভারী হওয়া৷ আর এর হালকা হাবার মানে হয় নেকীর পাল্লা পাপের পাল্লার তুলনায় হালকা হওয়া ৷ এছাড়া আরবী ভাষায় মীযান শব্দ ওজন অর্থেও ব্যবহৃত হয়৷ আর এই অর্থের দৃষ্টিতে ওজনের ভারী ও হালকা হবার মানে হয় নেকীর ওজন ভারী বা হালকা হওয়া ৷

যাহোক মাওয়াযীন শব্দটি মাওযূন , মীযান বা ওজন যে কোন অর্থেই ব্যবহার করা হোক না কেন সব অবস্থায় প্রতিপাদ্য একই থাকে এবং সেটি হচ্ছে : মানুষ আমলের যে পুঁজি নিয়ে আল্লাহর আদালতে আসবে তা ভারী না হালকা , অথবা মানুষের নেকী তার পাপের চেয়ে ওজনে বেশী না কম এরি ভিত্তিতে সেখানে ফায়সালা অনুষ্ঠিত হবে৷ এ বিষয়টি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হয়েছে৷ সেগুলো সব সামনে রাখলে এর অর্থ পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব হবে৷

  • সূরা আরাফে বলা হয়েছে : ” আর ওজন হবে সেদিন সত্য ৷ তারপর যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে ৷ আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে৷ ” ( ৮-৯ আয়াত)
  • সূরা কাহাফে বলা হয়েছে : ” হে নবী ! এই লোকদেরকে বলে দাও , আমি কি তোমাদের জানাবো নিজেদের আমলের ব্যপারে সবচেয়ে বেশী ব্যর্থ কারা ? তারাই ব্যর্থ যাদের দুনিয়ার জীবনে সমস্ত কর্মকাণ্ড সত্য সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থেকেছে এবং যারা মনে করতে থেকেছে , তারা সবকিছু ঠিক করে যাচ্ছে ৷ এই লোকেরাই তাদের রবের আয়াত মানতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর সামনে হাযির হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করেনি৷ তাই তাদের সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে গেছে৷ কিয়ামতের দিন আমি তাদের কোন ওজন দেবো না৷ ” (১০৪-১০৫ আয়াত)
  • সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছে : ” কিয়ামতের দিন আমি যথাযথ ওজন করার দাঁড়িপাল্লা রেখে দেবো৷ তারপর কারো ওপর অণু পরিমাণও জুলুম হবে না৷ যার সরিষার দানার পরিমাণও কোন কাজ থাকবে তাও আমি সামনে আনবো এবং হিসেব করার জন্য আমি যথেষ্ট৷” ( ৪৭ আয়াত )

এই আয়াতগুলো থেকে জানা যায় , কুফরী করা এবং সত্যকে অস্বীকার করা বৃহত্তম অসৎকাজের অন্তরভুক্ত৷ গুনাহের পাল্লা তাতে অনিবার্যভাবে ভারী হয়ে যায়৷ আর কাফেরের এমন কোন নেকী হবে না নেকীর পাল্লায় যার কোন ওজন ধরা পড়ে এবং তার ফলে পাল্লা ঝুঁকে পড়তে পারে৷ তবে মু’মিনের পাল্লায় ঈমানের ওজনও হবে এবং এই সংগে সে দুনিয়ায় যেসব নেকী করেছে সেগুলোর ওজনও হবে৷ অন্যদিকে তার সমস্ত গোনাহ গোনাহর পাল্লায় রেখে দেয়া হবে৷ তারপর নেকীর পাল্লা ঝুঁকে আছে গোনাহর পাল্লা ঝুঁকে আছে , তা দেখা হবে৷

এখানে বলা হচ্ছে সৎকাজের পাল্লা যাদের ভারী হবে তারা পুরস্কার স্বরূপ পাবে ‘সন্তোষজনক জীবন’ বা সুখের জীবন। সূরা বায়্যিনাহতেও বলা হয়েছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পুরস্কার স্বরূপ এমন জান্নাত দেওয়া হবে যাতে সে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও কুরআনে আল মায়েদা ১১৯, সূরা হাক্কাহ ২১, সূরা ফজর ২৮ উল্লেখ আছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদানটা এমন সুখের জীবন থাকবে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।

অর্থাৎ, যার নেকীর তুলনায় বদীর পরিমাণ বেশী হবে, ফলে পাপের পাল্লা ভারী হবে এবং পুণ্যের পাল্লা হালকা হবে।

মূল আরবী শব্দে أمه বলা হয়েছে। أم শব্দের অর্থ স্থান বা ঠিকানাও হয়। তাছাড়া যদি أم শব্দটির বিখ্যাত অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে তার অর্থ হবে, মা। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তার মা হবে জাহান্নাম। হাবিয়াহ জাহান্নাম কে কেন এখানে ‘মা’ বলা হলো? মায়ের কোল যেমন শিশুর অবস্থান হয় তেমনি জাহান্নামবাসীদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কোন অবস্থান হবে না।

আয়াতে উল্লেখিত ‘হাওয়িয়াহ’ শব্দটি জাহান্নামের একটি নাম। শব্দটি এসেছে ‘হাওয়া’ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে নীচুতে পড়ে যাওয়া। আর যে গভীর গর্তে কোন জিনিস পড়ে যায় তাকে হাওয়িয়া বলে। জাহান্নামকে হাওয়িয়া বলার কারণ হচ্ছে এই যে, জাহান্নাম হবে অত্যন্ত গভীর এবং জাহান্নামবাসীদেরকে তার মধ্যে ওপর থেকে নিক্ষেপ করা হবে।

এখানে জাহান্নামের ভয়াবহতা এবং আযাবের কঠিনতাকে বোঝানোর জন্য প্রশ্নবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এই সূরার ৩ নং আয়াতের মত। তা মানুষের কল্পনা ও ধারণার বাইরে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান তা আয়ত্ত করতে এবং তার প্রকৃতত্বকে জানতে অক্ষম।

এখানে حامية বলে বুঝানো হয়েছে, আগুনটি হবে অত্যন্ত উত্তপ্ত ও লেলিহান। [ইবন কাসীর] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আদম সন্তান যে আগুন ব্যবহার করে সেটি জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের একভাগ উত্তপ্ততা সম্পন্ন, সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এটাই তো শাস্তির জন্যে যথেষ্ট, তিনি বললেন, জাহান্নামের আগুন তার থেকে উনসত্তর গুণ বেশী উত্তপ্ত”। [বুখারী: ৩২৬৫] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের একভাগ। তারপরও তাকে দু’বার সমুদ্রের মাধ্যমে ঠাণ্ডা করা হয়েছে, নতুবা এর দ্বারা কেউই উপকৃত হতে পারত না।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/২৪৪]

অন্য হাদীসে এসেছে, “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে হাল্কা আযাব ঐ ব্যক্তির হবে যাকে আগুনের জুতা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তার কারণে তার মগজ উৎরাতে থাকবে।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৩২] হাদীসে আরও এসেছে, “জাহান্নাম তার রাবের কাছে অভিযোগ দিল যে, আমার একাংশ আরেক অংশকে খেয়ে ফেলছে। তখন তাকে দু’টি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দেয়া হলো, একটি শীতকালে অপরটি গ্ৰীষ্মকালে। সুতরাং যত বেশী শীত পাও সেটা জাহান্নামের ঠাণ্ডা থেকে আর যতি বেশী গরম অনুভব কর সেটাও জাহান্নামের উত্তপ্ততা থেকে।” [বুখারী: ৫৩৭, ৩২৬০, মুসলিম: ৬১৭] অন্য হাদীসে এসেছে, “তোমরা যখন দেখবে যে, গ্ৰীষ্মের উত্তপ্ততা বেশী হয়ে গেছে তখন তোমরা সালাত ঠাণ্ডা করে পড়ে; কেননা, কঠিন উত্তপ্ততা জাহান্নামের লাভা থেকে এসেছে।” [বুখারী: ৪৩৬, মুসলিম: ৬১৫]

ফুটনোট

  • ক্বারিয়াহ অর্থ মহাসংকট। ক্বারিয়াহ শব্দ তিনবার এসেছে এই সূরায় এবং একইভাবে সূরা হাক্কাহে কিয়ামতের কথা বলা হয়েছে।
  • প্রথম তিন আয়াতে কিয়ামতের শুরু প্রক্কালে সতর্ক করা হচ্ছে… মহা সংকট!! বলে। (৪-৫) নং আয়াতে কিয়ামতের অবস্থা বলা হচ্ছে। (৬-১১) নং আয়াতে আখিরাতে বিচারকার্যের বর্ণনা এবং মানুষের চিরস্থায়ী অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে।
  • কিয়ামতের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এই সূরায় তিনটি বিষয় এসেছে-
    • সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত,
    • পর্বতসমূহ হবে ধুনিত রঙ্গিন পশমের মত।
    • মানুষের আমলনামা পাল্লায় নেওয়া হবে।
  • কিয়ামতে দিন মানুষ দুইভাগে ভাগ হবে- যাদের আমলের পাল্লা ভারি হবে তারা সন্তোষ্টজনক জীবন (জান্নাত) লাভ করবে। যাদের পাল্লা হালকা হবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
  • ‘হাওয়িয়াহ’ শব্দটি জাহান্নামের একটি নাম। জাহান্নামের স্তর হল সাতটি। এর প্রথম স্তরে থাকবে গোনাহগার মুসলিমরা, দ্বিতীয় স্তরে ইয়াহুদীরা, তৃতীয় স্তরে খ্রিষ্টানরা, চতুর্থ স্তরে সাবায়ীরা, পঞ্চম স্তরে মজুসী (অগ্নিপূজক)রা, ষষ্ঠ স্তরে পৌত্তলিকরা এবং সর্বনিম্ন সপ্তম স্তরে থাকবে মুনাফিকরা। অনেকে উক্ত সাতটি স্তরের নির্দিষ্ট নামও উল্লেখ করেছেন; জাহান্নাম, লাযা, হুত্বামাহ, সাঈর, সাক্বার, জাহীম ও হাবিয়াহ।