কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২
প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ১০
সূরা হুমাযাহ
কুরআনের ১০৪ তম সূরা। এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৯ টি। হুমাযাহ অর্থ নিন্দুক।
নামকরণ
প্রথম আয়াতের (وَیۡلٌ لِّکُلِّ هُمَزَۃٍ لُّمَزَۃِۣ ۙ) হুমাযাহ শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নাযিলের সময় – কাল
এ সূরাটির মক্কী হবার ব্যাপারে সকল মুফাসসির একমত পোষণ করেছেন।এর বক্তব্য বিষয় ও বর্ণনাভংগী বিশ্লেষণ করলে এটিও রসূলের নবুওয়াত পাওয়ার পর মক্কায় প্রথমদিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তভুক্ত বলে মনে হয়।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এই সূরায় এমন কিছু নৈতিক অসৎবৃত্তির নিন্দা করা হয়েছে যেগুলো জাহেলী সমাজে অর্থলোলুপ ধনীদের মধ্যে পাওয়া যেতো। প্রত্যেক আরববাসী জানতো, এই অসৎ প্রবণতাগুলো যথাথই তাদের সমাজে সক্রিয় রয়েছে। সবাই এগুলোকে খারাপ মনে করতো।একজনও সৎগুণ মনে করতো না এবং প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতো না ।এই জঘন্য প্রবণতাগুলো পেশ করার পর আখেরাতে এই ধরনের চরিত্রের অধিকারী লোকদের পরিণাম কি হবে তা বলা হয়েছে।এই দু’টি বিষয় (অর্থাৎ একদিকে এই চরিত্র এবং অন্যদিকে আখেরাতে তার এই পরিণাম ) এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যার ফলে শ্রোতা নিজে নিজেই এই সিদ্ধান্তে পৌছুতে পারেন যে, এই ধরনের কাজের ও চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির পরিণাম এটিই হয়ে থাকে।আর যেহেতু দুনিয়ায় এই ধরনের চরিত্রের লোকেরা কোন শাস্তি পায় না বরং উলটো তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখা যায় তাই আখেরাত অনিবার্যভাবে অনুষ্ঠিত হবেই ।
সূরা যিলযাল থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো সূরা চলে এসেছে এই সূরাটিকে সেই ধারাবাহিকতার রেখে বিচার করলে মক্কা মু’আয্যমার প্রথম যুগে ইসলামী আকীদা – বিশ্বাস ও তার নৈতিক শিক্ষাবলী মানুষের হৃদয়পটে অংকিত করার জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল তা মানুষ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে।সূরা যিলযালে বলা হয়েছে, আখেরাতে মানুষের সমগ্র আমলনামা তার সামনে রেখে দেয়া হবে । সে দুনিয়ায় যে সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা গোনাহ করেছিল তা সেখানে তার সামনে আসবে না এমনটি হবে না।সূরা আদিয়াত – এ আরবের চতুর্দিকে যেসব লুটতরাজ, হানাহানি, খুনাখুনি ও দস্যূতা জারী ছিল সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে।তারপর আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিগুলোর এহেন অপব্যবহার তাঁর প্রতি বিরাট অকৃজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়, এ অনুভূতি জাগ্রত করার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারটি এই দুনিয়াতেই শেষ হয়ে যাবে না বরং মৃত্যুর পর আর একটি জীবন শুরু হচ্ছে, সেখানে কেবল তোমাদের সমস্ত কাজেরই নয় বরং নিয়তও যাচাই বা পর্যালোচনা করা হবে। আর কোন ব্যক্তি কোন ধরনের ব্যবহার লাভের যোগ্য তা তোমাদের রব খুব ভালোভাবেই জানে । সূরা আল কারিয়াহতে কিয়ামতের নকশা পেশ করার পর লোকদেরকে এই মর্মে সর্তক করে দেয়া হয়েছে যে, মানুষের নেকীর পাল্লা ভারী না গোনাহর পাল্লা ভারী হচ্ছে এরি ওপর নির্ভর করবে আখেরাতে তার ভালো বা মন্দ পরিণাম । যে বস্তুবাদী মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দুনিয়ার লাভ, স্বার্থ, আয়েশ – আরাম, ভোগ ও মর্যাদা বেশী বেশী করে অর্জন করার ও পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হবার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে সূরা তাকাসুরে তার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।তারপর এই গাফলতির অশুভ পরিণতি সস্পর্কে মানুষকে সজাগ করে বলা হয়েছে। এ দুনিয়া কোন লুটের মাল নয় যে, তার ওপর তোমরা ইচ্ছামতো হাত সাফাই করতে থাকবে।বরং এখানে তুমি এর যেসব নিয়ামত পাচ্ছো তার প্রত্যেকটি কিভাবে অর্জন করেছোএবং কিভাবে ব্যবহার করেছো তার জন্য তোমার রবের কাছে জবাবদিহি করতে হবে । সূরা আসর এ একেবারে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে, যদি মানবজাতির ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ঈমান ও সৎকাজ না থাকে এবং তার সমাজ ব্যবস্থায় হক পথ অবলম্বন ও সবর করার উপদেশ দেবার রীতি ব্যাপকতা লাভ না করে, তাহলে তার প্রত্যেক ব্যক্তি, দেশ জাতি এমনকি সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে অবস্থান করবে । এর পরপরই আসছে সূরা ‘আল হুমাযাহ।’ এখানে জাহেলী যুগের নেতৃত্বের একটি নমুনা পেশ করে লোকদের সামনে যেন এ প্রশ্ন রাখা হয়েছে যে, এই ধরনের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের অধিকারী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কেন ?
আগের ও পরের সূরার সাথে সম্পর্ক
পূর্ববর্তী ১০৩ নং সূরা আল আসর এ সময়কে গুরুত্ব ইহকালীন ও পরকালীন কৃতকার্যতার জন্য চারটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমান আনা, সৎকাজ করা, সত্যের উপদেশ দেওয়া, ধৈর্য্যের উপদেশ দেওয়া। আর যারা এ গুণ চারগুণের বাহক নয়, তারা সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অকৃতকার্য। অত্র সূরা ১০৪ নং সূরা আল হুমাযাহ এ গুরুত্বহীন ৪ টি কাজ এর কথা বলা হয়েছে। সামনে নিন্দা করা, পিছনে নিন্দা করা, অর্থ জমা করা এবং তা গুণে গুণে রাখা, অর্থ চিরকাল থাকবে মনে করা।
এ সূরায় মানুষের নৈতিক দুর্বলতার উল্লেখ রয়েছে। এই মর্মে যে, যারা পরনিন্দা ও পরচর্চা করবে, মানুষের প্রতি বিদ্রপাত্বক মন্তব্য করবে, তাদের জন্য পরকালে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে! আর পরের সূরা ফীলে – এ কথা যোগ করা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করবে এবং দীন ইসলামের সাথে শত্রুতা করবে তাদের শাস্তি যে পরকালেই হবে তা নয়; বরং আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে ও তাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন ! আর তাদের অন্যায় আচরণই হবে তাদের ধ্বংসের কারণ! যৈমন ইয়েমেনের রাজা আবরাহাকে আল্লাহ তা’আলা তার বিরাট সৈন্য ও হাস্তিবাহিনীসহ ক্ষণিকের মধ্যে ধ্বংস করেছিলেন। -[নূরুল কোরআন]
আয়াতে ‘হুমাযাহ’ ও ‘লুমাযাহ’ দু’টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে همز এর অর্থ গীবত অর্থাৎ পশ্চাতে পরনিন্দা করা এবং لمز এর অর্থ সামনাসামনি দোষারোপ করা ও মন্দ বলা। এ দুটি কাজই জঘন্য গোনাহ। তাফসীরকারগণ এ শব্দ দুটির আরও অর্থ বর্ণনা করেছেন। তাদের বর্ণিত তাফসীর অনুসারে উভয় শব্দ মিলে এখানে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছে: সে কাউকে লাঞ্ছিত ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। কারোর প্রতি তাচ্ছিল্য ভরে অংগুলি নির্দেশ করে। চোখের ইশারায় কাউকে ব্যঙ্গ করে কারো বংশের নিন্দা করে। কারো ব্যক্তি সত্তার বিরূপ সমালোচনা করে। কারো মুখের ওপর তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করে। কারো পেছনে তার দোষ বলে বেড়ায়। কোথাও এর কথা ওর কানে লাগিয়ে বন্ধুদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। কোথাও ভাইদের পারস্পরিক ঐক্যে ফাটল ধরায়। কোথাও লোকদের নাম বিকৃত করে খারাপ নামে অভিহিত করে। কোথাও কথার খোঁচায় কাউকে আহত করে এবং কাউকে দোষারোপ করে। এসব তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এসবই মারাত্মক গোনাহ।
পশ্চাতে পরনিন্দার শাস্তির কথা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ এরূপ হতে পারে যে, এ গোনাহে মশগুল হওয়ার পথে সামনে কোন বাধা থাকে না। যে এতে মশগুল হয়, সে কেবল এগিয়েই চলে। ফলে গোনাহ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ও অধিকতর হতে থাকে। সম্মুখের নিন্দা এরূপ নয়। এতে প্রতিপক্ষও বাধা দিতে প্ৰস্তুত থাকে। ফলে গোনাহ দীর্ঘ হয় না। এছাড়া কারও পশ্চাতে নিন্দা করা এ কারণেও বড় অন্যায় যে, সং ব্যক্তি জানতেও পারে না যে, তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। ফলে সে সাফাই পেশ করার সুযোগ পায় না। আবার একদিক দিয়ে لمز তথা সম্মুখের নিন্দা গুরুতর। যার মুখোমুখি নিন্দা করা হয়, তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা হয়। এর কষ্টও বেশি, ফলে শাস্তিও গুরুতর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম তারা, যারা পরোক্ষ নিন্দা করে, বন্ধুদের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ লোকদের দোষ খুঁজে ফিরে।” [মুসনাদে আহমাদ: ৪/২২৭]
তবে ব্যবহারিকভাবে দু’টি শব্দের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেটি হ’ল الهمز بالفعل واللمز باللسان। অর্থাৎ همز হ’ল কাজের মাধ্যমে নিন্দা করা, আর لمز হ’ল কথার মাধ্যমে নিন্দা করা। প্রথমটির উদাহরণ হিসাবে মক্কার ধনকুবের অলীদ বিন মুগীরাহর চোগলখুরী চরিত্র তুলে ধরে আল্লাহ বলেন, هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيْمٍ ‘সে পিছনে নিন্দা করে এবং একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে বেড়ায়’ (সূরা ক্বলম ৬৮/১১)। দ্বিতীয়টির উদাহরণ হিসাবে মুনাফিক ও দুনিয়াপূজারীদের চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা ছাদাক্বা বণ্টনে তোমাকে পিছনে দোষারোপ করে। তারা কিছু পেলে খুশী হয়, আর না পেলে ক্ষুব্ধ হয়’ (সূরা তওবা ৯/৫৮)।
আয়াতটি রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে নিন্দাকারী মক্কার নেতা আখনাস বিন শারীক্ব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উবাই ইবনে খালাফ প্রমুখের উদ্দেশ্যে নাযিল হ’লেও এর বক্তব্য সর্বযুগের সকল পরনিন্দাকারীর জন্য প্রযোজ্য।
অর্থাৎ নিজের অগাধ ধনদৌলতের অহংকারে সে মানুষকে এভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে। যেসব বদভ্যাসের কারণে আয়াতে শাস্তির কথা উচ্চারণ করা হয়েছে, তন্মধ্যে এটি হচ্ছে তৃতীয়। যার মূল কথা হচ্ছে অর্থালিপ্সা। আয়াতে একে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে— অর্থালিপ্সার কারণে সে তা বার বার গণনা করে। গুণে গুণে রাখা বাক্য থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কার্পণ্য ও অর্থ লালসার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তবে অন্যান্য আয়াত ও হাদীস সাক্ষ্য দেয় যে, অর্থ সঞ্চয় করা সর্বাবস্থায় হারাম ও গোনাহ নয়। তাই এখানেও উদ্দেশ্য সেই সঞ্চয় হবে, যাতে জরুরি হক আদায় করা হয় না, কিংবা গর্ব ও অহমিকা লক্ষ্য হয় কিংবা লালসার কারণে দ্বীনের জরুরি কাজ বিঘ্নিত হয়।
মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব বলেন, – ‘দিনের বেলায় মাল তাকে গাফেল রাখে এই মাল ঐ মাল করে। আর রাতের বেলায় সে ঘুমে মরা লাশের মত পড়ে থাকে’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ সে কেবল টাকার পিছনে ছুটেই জীবন শেষ করে। রূহের খোরাক দেয় না। আল্লাহর হক আদায় করে না। ইবাদতের জন্য তার সময় জোটে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَجَمَعَ فَأَوْعَى ‘সে সম্পদ জমা করে ও তা আগলে রাখে’ (মা‘আরেজ ৭০/১৮)। অত্র আয়াতে পুঁজিবাদীদের প্রচন্ডভাবে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, যাকাত আদায় ও প্রয়োজনীয় দানশীলতা বজায় রেখে ভবিষ্যতের জন্য মাল সঞ্চয় করা দোষণীয় নয়। বরং দোষণীয় হলো- মাল উপার্জন ও সঞ্চয় করাকেই মুখ্য বিষয় হিসাবে গণ্য করা ও সেই চিন্তায় জীবনপাত করা।
এর অর্থ হচ্ছে এই যে, সে মনে করে তার অর্থ-সম্পদ তাকে চিরন্তন জীবন দান করবে। টাকা থাকলে স্বাস্থ্য-সুখ সবই ঠিক থাকবে এবং সে দুনিয়াতে চিরস্থায়ী হবে, এমন এক উদ্ভট ধারণা ধনলিপ্সু কৃপণ লোকেরা মনের মধ্যে লালন করে থাকে। অর্থাৎ অর্থ জমা করার এবং তা গুণে রেখে দেবার কাজে সে এত বেশী মশগুল যে নিজের মৃত্যুর কথা তার মনে নেই। তার মনে কখনো এ চিন্তার উদয় হয় না যে, এক সময় তাকে এসব কিছু ছেড়ে দিয়ে খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। তাছাড়া তাকে এ সম্পদের হিসাবও দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন কোন বান্দার দু’পা সামনে অগ্রসর হতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে নিম্নোক্ত বিষয় জিজ্ঞাসা করা না হয়, তার জীবনকে কিসে নিঃশেষ করেছে; তার জ্ঞান দ্বারা সে কী করেছে; তার সম্পদ কোত্থেকে আহরণ করেছে ও কিসে ব্যয় করেছে এবং তার শরীর কিসে খাটিয়েছে।” [তিরমিযী: ২৪১৭]
হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘মৃত ব্যক্তির সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন তার সাথে থেকে যায়। সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’।
كَلاَّ হ’ল প্রত্যাখ্যানকারী অব্যয়। অর্থাৎ ধনলিপ্সু কাফেররা যা ধারণা করে, সেটা কখনোই হবার নয়। অতএব كَلاَّ অর্থ حَقَّا لَيُنْبَذَنَّ ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে’। অথবা উহ্য শপথের জওয়াব, وَاللهِ لَيُنْبَذَنَّ আল্লাহর কসম! সে নিক্ষিপ্ত হবে’।
এখানে ‘কখনোই না’ বলে একথা বুঝানো হয়েছে যে, ধন-সম্পদ কাউকে চিরজীবী বা দীর্ঘজীবী করে না। বরং মাল ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তার নেক আমল বেঁচে থাকে। এই নেক আমল বা সৎকর্ম তাকে যেমন দুনিয়াতে সুনাম-সুখ্যাতির সাথে বাঁচিয়ে রাখে, আখেরাতেও তেমনি তার সাথী হয় এবং তার জান্নাতের অসীলা হয়।
لَيُنْبَذَنَّ: আরবী ভাষায় কোন জিনিসকে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া অর্থে ( نبذ – নবয) শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ এ থেকে আপনা আপনি এই ইংগিত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নিজের ধনশালী হওয়ার করণে সে দুনিয়ায় নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে৷ কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকে ঘৃণাভরে জাহান্নামে ছুঁড়ে দেয়া হবে৷
হুতামা শব্দটির মূল হচ্ছে, হাতম। হাতম মানে ভেঙ্গে ফেলা, পিষে ফেলা ও টুকরা করে ফেলা। জাহান্নামকে হাতম নামে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে যা কিছু ফেলে দেয়া হবে তাকে সে নিজের গভীরতা ও আগুনের কারণে ভেঙ্গে গুড়িয়ে রেখে দেবে। ইবনু কাছীর (রহঃ) জাহান্নামের আটটি নাম উল্লেখ করেছেন। যথা : নার, জাহীম, সাক্বার, জাহান্নাম, হাভিয়াহ, হাফেরাহ, লাযা, হুত্বামাহ (নাযে‘আত ১০ আয়াতের তাফসীর)।
এই প্রশ্নসূচক বাক্য ‘হুত্বামাহ’ জাহান্নামের ভয়াবহতাকে ব্যক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, সেটা এমন ভয়ংকর আগুন হবে, যার প্রকৃতত্বে তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি পৌঁছতে পারে না এবং তোমার সমঝ ও অনুভব তা আয়ত্ত করতে পারে না।
এখানে موقدة অর্থ অত্যন্ত লেলিহান শিখাযুক্ত প্ৰজ্বলিত আগুন।
কুরআন মজীদের একমাত্র এখানে ছাড়া আর কোথাও জাহান্নামের আগুনকে আল্লাহর আগুন বলা হয়নি৷ এখানে এই আগুনকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কেবলমাত্র এর প্রচণ্ডতা ও ভয়াবহতারই প্রকাশ হচ্ছে না৷ বরং এই সংগে এও জানা যাচ্ছে যে , দুনিয়ার ধন – সম্পদ লাভ করে যারা অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় মেতে ওঠে তাদেরকে আল্লাহ কেমন প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন৷ এ কারণেই তিনি জাহান্নামের এই আগুনকে নিজের বিশেষ আগুন বলেছেন এবং এই আগুনেই তাকে নিক্ষেপ করা হবে৷
‘তাত্তালিউ’ শব্দটির মূলে হচ্ছে ইত্তিলা। আর ‘ইত্তিলা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে চড়া, আরোহণ করা ও ওপরে পৌছে যাওয়া। [জালালাইন] “আফইদাহ’’ শব্দটি হচ্ছে বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে ‘ফুওয়াদ’। এর মানে হৃদয় বা কলিজা। অর্থাৎ জাহান্নামের এই আগুন হৃদয়কে পর্যন্ত গ্ৰাস করবে। হৃদয় পর্যন্ত এই আগুন পৌঁছাবার –
- একটি অর্থ হচ্ছে এই যে, এই আগুন এমন জায়গায় পৌছে যাবে যেখানে মানুষের অসৎচিন্তা, ভুল আকীদা-বিশ্বাস, অপবিত্র ইচ্ছা, বাসনা, প্রবৃত্তি, আবেগ এবং দুষ্ট সংকল্প ও নিয়তের কেন্দ্র।
- এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর এই আগুন দুনিয়ার আগুনের মতো অন্ধ হবে না। সে দোষী ও নির্দোষ সবাইকে জ্বলিয়ে দেবে না। বরং প্রত্যেক অপরাধীর হৃদয় অভ্যন্তরে পৌছে সে তার অপরাধের প্রকৃতি নির্ধারণ করবে এবং প্রত্যেককে তার দোষ ও অপরাধ অনুযায়ী আযাব দেবে।
- এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, দুনিয়ার আগুন মানুষের দেহে লাগলে হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছার আগেই মৃত্যু হয়ে যায়। জাহান্নামে মৃত্যু নেই। কেননা আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘সেখানে তারা মরবেও না এবং বাঁচবেও না’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৪; আ‘লা ৮৭/১৩)। এখানে নির্দিষ্টভাবে ‘কলিজা’ বলার কারণ হ’ল এই যে, এটিই হ’ল দেহের সবচেয়ে নরম স্থান এবং আগুন যখন কলিজায় পৌঁছে যায়, তখন মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি শাস্তির কঠোরতায় মৃত্যুর দুয়ারে উপনীত হবে। কিন্তু মরবে না, যাতে সে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। আবার বাঁচবেও না যাতে সে স্বস্তি লাভ করে।
ُّؤْصَدَةٌ অর্থ – চারদিক থেকে দরজা বন্ধ থাকবে, সেখান থেকে বের হবার কোন পথ পাবে না’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘যখনই তারা জাহান্নাম থেকে বের হ’তে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে আর বলা হবে, আগুনের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো, যাকে তোমরা মিথ্যা বলতে’ (সাজদাহ ৩২/২০)। অর্থাৎ অপরাধীদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নিক্ষেপ করে ওপর থেকে তা বন্ধ করে দেয়া হবে। কোন দরজা তো দুরের কথা তার কোন একটি ছিদ্ৰও খোলা থাকবে না। [ইবন কাসীর]
ফি আমাদিম মুমাদ্দাদাহ -এর একাধিক মানে হতে পারে৷ যেমন এর একটি মানে হচ্ছে , জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর উঁচু উঁচু থাম গেঁড়ে দেয়া হবে ৷ এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে,এই অপরাধীরা উঁচু উঁচু থামের গায়ে বাঁধা থাকবে৷ এর তৃতীয় অর্থ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন , এই আগুনের শিখাগুলো লম্বা লম্বা থামের আকারে ওপরের দিকে উঠতে থাকবে৷
ফুটনোট
* ১ম আয়াতে ‘হুমাযাহ’ ও ‘লুমাযাহ’ দু’টি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে همز এর অর্থ গীবত অর্থাৎ পশ্চাতে পরনিন্দা করা এবং لمز এর অর্থ সামনাসামনি দোষারোপ করা ও মন্দ বলা।
* মানুষের মাঝে বিরাজিত তিনটি পাপকে কঠোর ভাষাতে নিন্দা করা হয়েছে :
১) কুৎসা রটনাকারী, ২) গীবতকারী ৩) যারা সম্পদের পাহাড় গড়তে ভালোবাসে, কিন্তু তা কখনও জনহিতকর কাজে ব্যয় করে না।
* এই তিনটি পাপের জন্য মানুষকে হুতামায় নিক্ষিপ্ত হতে হবে।
* হুতামার পরিচয় এই সূরায় দেওয়া হচ্ছে-
১) এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন,
২ ) যা হৃদয়কে গ্ৰাস করবে;
৩) উঁচু উঁচু স্তম্ভসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রাখা হবে