Notes 11- Sura Dahr 1 to 22 ayat

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ১১

সূরা দাহর (১-২১ আয়াত)

সূরা আদ-দাহর‌ কুরআনের ৭৬ নম্বর সূরা; এর আয়াত সংখ্যা ৩১ এবং রূকু সংখ্যা ২। সূরা আদ-দাহর মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইনসান শব্দের অর্থ মানুষ। দাহর শব্দের অর্থ কাল, সময়, যুগ।

নামকরণঃ

সূরার একটি নাম আদ দাহর এবং আরেকটি নাম আল ইনসান। দু’টি নামই এর প্রথম আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে। 

সূরাটির বিষয়বস্তু ও সারকথা: এ সূরার আলোচ্য বিষয়বস্তু ও মূলবক্তব্য হলো- এ দুনিয়ায় মানুষের স্থান কোথায় এবং তার অবস্থানের স্বরূপ কি? তাদেরকে এ জগতে কেন পাঠানো হয়েছে, এখানে তাদের কর্তব্য কিঃ এ জগতে তাদেরকে কুফরের পথ বা  ঈমানের পথ এ দু’য়ের কোনো একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে- যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করবে তাদের পুরস্কার পরকালে কি হবে এবং যারা কুফরের পথ গ্রহণ করবে তাদের পরিণাম ফলাফল কি হবে,  এসব বিষয়ই এ সূরায় তুলে ধরা হয়েছে।

১-৬ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন নর-নারীর দেহাভ্যন্তরে অণু আকারে শুক্রকীটরূপে অবস্থান করছিল, তখন তারা উল্লেখযোগ্য বস্তু বলতে কিছুই ছিল না। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে নর-নারীর মিলিত শুক্রের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর এ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো পার্থিব জীবনটিকে তাদের জন্য একটি পরীক্ষাগার করা। এ পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই তাদেরকে চক্ষু ও কর্ণ দওয়া হয়েছে যাতে তারা ভালোমন্দ দেখতে ও শুনতে পায় । আর তাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে তাদের নিকট নবী-রাসূল ও কিতাব দিয়ে পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা সঠিক পথ কোনটি তা জানবার সুযোগ পায় । সুতরাং এরপর তাদেরকে এ যার জীবনে ভালোমন্দ, ঈমানী ও কুফরি পথের যে কোনো একটি পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছা করলে  তারা কুফরির পথ গ্রহণ করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে ঈমানের পথও গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু যারা কুফরির পথ গ্রহণ করে অকৃতজ্ঞ হবে তাদের শাস্তির জন্য শৃঙ্খল-বেড়ি ও লেলিহান অগ্নি প্রস্তুত রয়েছে। আর যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করে নেককার বং তদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে চিরন্তন জান্নাত । তাতে তারা কাফুর মিশ্রিত পানীয় পান করবে।

৯-২২ নং আয়াতে মু’মিন বান্দাদের প্রশংসা করে জান্নাতে তাদের অপূর্ব ও অফুরন্ত অর্থ নিয়ামতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা  হয়েছে আমার মু’মিন বান্দাগণ আমার নামে যে মান্নত করে তা পূর্ণরূপে আদায় করে, তারা এতিম, মিসকিন ও বন্দীগণকে পানাহার করায় দুনিয়ার কোনো স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য; বরং নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে থাকে এমনকি তাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরও আশা তারা করে না। তারা ভয়াবহ কিয়ামত ও হিসাব-নিকাশের ভয় করে । সুতরাং পরকালে তারা আল্লাহর নিয়ামত লাভ করে পরম আনন্দ ও সুখ ভোগ করবে, তাদের চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে । তাছাড়া তারা জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত উপভোগ করবেন।

২৩-৩১ আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন আমারই কালাম ! আমিই বিভিন্ন সময় প্রয়োজন অনুসারে খণ্ড খণ্ড করে তা অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং কাফেরগণ যা কিছুই বলুক সেদিকে কর্ণপাত করবেন না। আপনি আপনার প্রতিপালকের হুকুমের অপেক্ষায় খাকুন। আপনি পাপিষ্ঠ ও কাফের লোকদের কথা মেনে চলবেন না। আপনি সকাল-সন্ধ্যায় আপনার প্রতিপালকের স্মরণে থাকুন এবং রাত্রিকালে দীর্ঘক্ষণ নামাজে অতিবাহিত করুন৷ কাফেরগণ এ দুনিয়াকে অতিশয় ভালোবাসে বলেই পরকালকে ছেড়ে দিয়েছে। এ কাফের পাপিষ্ঠগণকে আমিই সৃষ্টি করেছি এবং তাদেরকে ধ্বংস করে তাদের স্থলে অন্য জাতি সৃষ্টি করতে আমি পূর্নমাত্রায় সক্ষম ৷ বস্তুত আমার এ কুরআন হচ্ছে উপদেশ ভাণ্ডার। যার ইচ্ছা হয় সে তার উপদেশ গ্রহণ করে তার প্রতিপালকের পথ গ্রহণ করুক; অথবা ভাকে পরিহার করুক । এ ব্যাপারে মানুষকে পূর্ণমাতরায় স্বাধীন রাখা হয়েছে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর অনুগ্রহ দান করেন; কিন্তু সীমালঙ্ঘনকারী কাফেরদের প্রতি রয়েছে তার নির্মম চিরন্তন শাস্তি । অতএব, হে মানবকুল সাবধান!

আগের পরের সূরার সাথে সম্পর্ক

৭৫ নং  সূরা কিয়ামাহ ‘ইনসান’ শব্দটি ৬বার উল্লেখ করার হয়েছে আর এ সূরা প্রথম আয়াতেই ইনসান শব্দ এসেছে। এবং এ সূরার নামই সূরা ইনসান। আগের সূরার ২০-২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-কখনও না, বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে ভালবাস সূরা দাহরে একইভাবে ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে- নিশ্চয় এরা পার্থিব জীবনকে ভালবাসে এবং এক কঠিন দিবসকে পশ্চাতে ফেলে রাখে।

এ সূরায় বলা হয়েছে যে, এমনও সময় ছিল যখন মানুষ উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না, আল্লাহ্‌ তায়ালাই তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আর পরবর্তী সূরা মুরসালাতে এই ঘোষণা করা হয়েছে যে, মানুষকে পুনজীর্বন দান করা হবে এবং কিয়ামতের যে কথা ঘোষণা করা হয়েছে তা অবশ্যই ঘটবে।

সূরার ফযীলত

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আহর দিন ফজরের সালাতে  আলিফ, লাম, মীম, তানজিল” (সূরা আস সেজদাহ্ ) এবং “হাল-আতা-আলাল-ইনসানী” (সূরা আদ-দাহর)  দু’টি সূরাহ্ তিলাওয়াত করতেন। (১০৬৮; মুসলিম ৭/৬৪, হাঃ ৮৮০)

 

 

هل  অব্যয়টি আসলে প্রশ্নবোধকরূপে ব্যবহৃত হয়। মাঝে মাঝে কোন জাজ্বল্যমান ও প্রকাশ্য বিষয়কে প্রশ্নের আকারে ব্যক্ত করা যায়, যাতে তার প্রকাশ্যতা আরও জোরদার হয়ে যায়। এখানে অধিকাংশ মুফাস্সির ও هل (হাল) শব্দটিকে قَدْ (ক্বাদ) শব্দের অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং এর অর্থ করেছেন নিঃসন্দেহে মানুষের ওপরে এরূপ একটি সময় এসেছিল৷

الإنسَان বলতে কেউ কেউ, প্রথম মানুষ আদম (আঃ)-কে বুঝিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মুফাসসেরগণের নিকট ‘মানুষ’ শব্দটি শ্রেণীবাচক অর্থে ব্যবহার করেছেন।

 

আয়াতের دَّهۡر (দাহরি )অর্থ -অন্তহীন মহাকাল যার আদি-অন্ত কিছুই মানুষের জানা নেই৷ আর حِیۡنٌ (হিনা) অর্থ অন্তহীন এ মহাকালের বিশেষ একটি সময়, মহাকাল প্রবাহের কোন এক পর্যায়ে যার আগমন ঘটেছিল৷ বক্তব্যের সারমর্ম হলো, এ অন্তহীন মহাকালের মধ্যে একটি দীর্ঘ সময় তো এমন অতিবাহিত হয়েছে যখন মানব প্রজাতির আদৌ কোন অস্তিত্ব ছিল না৷ তারপর এ মহাকাল প্রবাহে এমন একটি সময় আসলো যখন মানুষ নামের একটি প্রজাতির সূচনা করা হলো৷ এ সময়-কাল প্রত্যেক মানুষের জন্য এমন একটি সময় এসেছে যখন তাকে শূন্য মাত্রা বা অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বদানের সূচনা করা হয়েছে৷

 

لَمۡ یَکُنۡ شَیۡئًا مَّذۡکُوۡرًا আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের উপর এমন দীর্ঘ এক সময় অতিবাহিত হয়েছে, যখন পৃথিবীতে তার নাম-নিশানা এমন কি, আলোচনা পর্যন্ত ছিল না। আয়াতে বৰ্ণিত “যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না” এখানে মানবসৃষ্টির পূর্বের অবস্থা ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ অন্তহীন মহাকালের মধ্যে একটি দীর্ঘ সময় তো এমন অতিবাহিত হয়েছে যখন মানব প্ৰজাতির আদৌ কোন অস্তিত্ব ছিল না। তারপর মহাকাল প্রবাহে এমন একটি সময় আসল যখন মানুষ নামের একটি প্রজাতির সূচনা করা হল।

 

আমরা তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু থেকে

এখানে মানব সৃষ্টির সূচনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আমি মানুষকে মিশ্র বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি। বলাবাহুল্য এখানে নর ও নারীর মিশ্র বীর্য বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি পুরুষ ও নারীর দুটি আলাদা বীর্য দ্বারা হয়নি। বরং দুটি বীর্য সংমিশ্রিত হয়ে যখন একটি হয়ে গিয়েছে তখন সে সংমিশ্রিত বীর্য থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ তফসীরবিদ তাই বলেছেন।

 

আমরা তাকে পরীক্ষা করব;

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল, তাকে পরীক্ষা করা। যেমন তিনি বলেছেন, ‘‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করবার জন্য; কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম?’’ (সূরা মুলকঃ ২ আয়াত)

 

তাই আমরা তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন।

বলা হয়েছে ‘আমরা তাকে বানিয়েছি শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী’। বিবেকবুদ্ধির অধিকারী করেছি বললে এর সঠিক অর্থ প্ৰকাশ পায়। আল্লাহ তা’আলা তাকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির শক্তি দিয়েছেন যাতে সে পরীক্ষা দেয়ার উপযুক্ত হতে পারে। এখানে এর অর্থ হলো, শোনা ও দেখার সেসব উপায়-উপকরণ যার সাহায্যে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়৷ তাছাড়া শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি যেহেতু মানুষের জ্ঞানার্জনের উপায়-উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাই সংক্ষেপে এগুলোরই উল্লেখ করা হয়েছে৷ মানুষ যেসব ইন্দ্রিয়ের সাহায্য জ্ঞান অর্জন করে থাকে আসলে এসব ইন্দ্রিয়ের সবগুলোকেই এখানে বুঝানো হয়েছে৷ তাছাড়া মানুষকে যেসব ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি দেয়া হয়েছে তা ধরন ও প্রকৃতিগত দিক দিয়ে পশুদের ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি শক্তি থেকে সমপূর্ণ ভিন্ন৷ কারণ মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের পেছনে একটি চিন্তাশীল মন-মগজ বর্তমান যা ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান ও তথ্যসমূহকে একত্রিত ও বিন্যস্ত করে তা থেকে ফলাফল বের করে ,মতামত স্থির করে এবং এমন কিছু সিদ্ধান্ত করে যার ওপরে তার কার্যকলাপ ও আচরণের ভিত্তি স্থাপিত হয়৷ তাই মানুষকে সৃষ্টি করে আমি তাকে পরীক্ষা করেত চাচ্ছিলাম একথাটি বলার পর আমি এ উদ্দেশ্যেই তাকে سَمِیۡعًۢا ও بَصِیۡرًا অর্থাৎ “শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি” কথাটি বলার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তা”আলা তাকে জ্ঞান ও বিবেক -বুদ্ধির শক্তি দিয়েছেন যাতে সে পরীক্ষা দেয়ার উপুযুক্ত হতে পারে৷

 

এ আয়াত পূর্বের আয়াতে বর্ণিত পরীক্ষার ফলে মানুষের কি অবস্থা হয়েছে তা বিধৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, আমি রাসূল ও আসমানী গ্রন্থের মাধ্যমে তাকে পথ বলে দিয়েছি যে, এই পথ জান্নাতের দিকে এবং ঐ পথ জাহান্নামের দিকে যায়। এরপর তাকে ক্ষমতা দিয়েছি যে কোন পথ অবলম্বন করার। সুতরাং আমি তাকে শুধু জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেইনি বরং এগুলো দেয়ার সাথে সাথে তাকে পথও দেখিয়েছি। যাতে সে জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরীর পথ কোনটি। এরপর যে পথই সে অবলম্বন করুক না কেন তার জন্য সে নিজেই দায়ী। এ বিষয়টিই অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, “আমরা তাকে দুটি পথ (অর্থাৎ ভাল ও মন্দ পথ) স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছি।” [সূরা আল-বালাদ: ১০] অন্যত্র বলা হয়েছে এভাবে, “শপথ (মানুষের) প্রবৃত্তির আর সে সত্তার যিনি তাকে (সব রকম বাহ্যিক) ও আভ্যন্তরীণ শক্তি দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। আর পাপাচার ও তাকওয়া-পরহেজগারীর অনুভূতি দু’টোই তার ওপর ইলহাম করেছেন।” [সূরা আশ-শামস: ৭–৮]

এখান থেকে উপরোক্ত আয়াতসমূহে বর্ণিত দুটি শ্রেণীর প্রতিফল ও পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার কাফেরদের জন্যে রয়েছে শিকল, বেড়ি ও জাহান্নাম। আর ঈমান ও ইবাদত পালনকারীদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত নি’আমত।

الۡاَبۡرَارَ – এর অর্থ এমন সব মানুষ যারা পুরোপুরি তাদের রবের আনুগত্য করেছে, তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালন করেছে এবং তাঁর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত রয়েছে৷

 

পরে আয়াতাংশে সর্বপ্রথম পানীয় বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদেরকে এমন শরাবের পাত্র দেয়া হবে, যাতে কাফুরের মিশ্রণ থাকবে। অর্থাৎ তা হবে এমন একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার পানি হবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন এবং শীতল আর তার খোশবু হবে অনেকটা কপূরের মত। কোন কোন তফসীরকারক বলেনঃ কাফুর জান্নাতের একটি ঝরণার নাম। এই শরাবের স্বাদ ও গুণ বৃদ্ধি করার জন্যে তাতে এই ঝরণার পানি মিলানো হবে। যদি কাফুরের প্রসিদ্ধ অর্থ নেয়া হয়, তবে জরুরী নয় যে, জান্নাতের কাফুর দুনিয়ার কাফুরের ন্যায় অখাদ্য হবে। বরং সেই কাফুরের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হবে।

‘আল্লাহর বান্দাগণ’ কিংবা ‘রহমানের বান্দাগণ’ শব্দগুলো আভিধানিক অর্থে সমস্ত মানুষের জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ সবাই আল্লাহর বান্দা। কিন্তু তা সত্বেও কুরআন মজীদে যেখানেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তার দ্বারা আল্লাহর নেককার বান্দাগণকেই বুঝানো হয়েছে। অসৎ লোক, যারা নিজেরাই নিজেদেরকে আল্লাহর বন্দেগী তথা দাসত্বের বাইরে রেখেছে, তারা যেন এর যোগ্য-ই নয় যে, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নিজের মহান নামের সাথে যুক্ত করে অথবা এর মতো সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত করবেন।

এখানে এমন একটি ঝর্ণা- তা হবে এমন একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার পানি হবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন এবং শীতল আর তার খোশবু হবে অনেকটা কার্পূরের মত৷ জান্নাতের মধ্যে যেখানেই তারা চাইবে সেখানেই এ ঝর্ণা বইতে থাকবে৷ এ জন্য তাদের নির্দেশ বা ইংগিতই যথেষ্ট হবে৷ যথেচ্ছা প্রবাহিত করবে কথাটি এ বিষয়টির প্রতিই ইংগিত করে৷

“নযর” বা মানত পূরণ করার একটা অর্থ হলো, মানুষের ওপর যা কিছু ওয়াজিব করা হয়েছে তা তারা পূরণ করবে৷ দ্বিতীয় অর্থ হলো, মানুষ তার নিজের ওপর যা ওয়াজিব করে নিয়েছে কিংবা অন্য কথায় সে যে কাজ করার সংকল্প ব ওয়াদা করেছে তা পূরণ করবে৷ তৃতীয় অর্থ হলো, ব্যক্তির ওপরে যা ওয়াজিব তা সে পূরণ করবে৷ তা তার ওপর ওয়াজিব করা হয়ে থাকুক অথবা সে নিজেই তার ওপর ওয়াজিব করে নিয়ে থাকুক৷ এ তিনটি অর্থের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থটি বেশী পরিচিত এবং “নযর” শব্দ দ্বারা সাধারণত এ অর্থটিই বুঝানো হয়ে থাকে৷ এখানে মানত পূর্ণ করাকে জান্নাতীদের মহান প্রতিদান ও অফুরন্ত নেয়ামত লাভের কারণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে কাতাদাহ রাহেমাহুল্লাহ বলেন, এখানে  نذر শব্দ দ্বারা ‘কর্তব্য’ বোঝানো হয়েছে। তখন অর্থ হবে, তারাই জান্নাতের অধিকারী হবে যারা নিজেদের কর্তব্য যেমন সালাত, সাওম, হজ, উমরা ইত্যাদি যথাযথভাবে পালন করেছে।

অর্থাৎ জান্নাতীদের এসব নেয়ামত এ কারণেও যে, তারা দুনিয়াতে অভাবগ্ৰস্ত, এতীম ও বন্দীদেরকে আহার্য দান করত। অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে, এখানে حبه এর সর্বনাম দ্বারা طعام বা খাবার উদ্দেশ্য। অর্থাৎ খাদ্য অত্যন্ত প্রিয় ও আকর্ষণীয় হওয়া সত্বেও এবং নিজেরাই খাদ্যের মুখাপেক্ষী হওয়া সত্বেও নেককার লোকেরা তা অন্যদেরকে খাওয়ান। আবু সুলাইমান আদ-দারানী বলেন, حبه এর সর্বনাম দ্বারা আল্লাহ্‌ তা’আলাকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহ তা’আলার মহব্বতে এরূপ করে থাকে। পরবর্তী আয়াতাংশ ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যেই তোমাদের খাওয়াচ্ছি’ এ অর্থকেই সমর্থন করে।

এ আয়াতে বন্দী বলতে কাফের হোক বা মুসলিম, যুদ্ধবন্দী হোক বা অপরাধের কারণে বন্দী হোক সব রকম বন্দীকে বুঝানো হয়েছে। বন্দী অবস্থায় তাদেরকে খাদ্য দেয়া, মুসলিম কিংবা অমুসলিম, সর্বাবস্থায় একজন অসহায় মানুষকে-যে তার খাবার সংগ্রহের জন্য নিজে কোন চেষ্টা করতে পারে না- খাবার দেয়া অতি বড় সওয়াবের কাজ। যেমন বদর যুদ্ধের কাফের বন্দীদের ব্যাপারে নবী (সাঃ) সাহাবাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তাদের সম্মান কর। তাই সাহাবায়ে কেরাম প্রথমে তাদেরকে খাবার খাওয়াতেন এবং তাঁরা নিজেরা পরে খেতেন।

কোন গরীবকে খেতে দেয়া যদিও বড় নেকীর কাজ, কিন্তু কোন অভাবী মানুষের অন্যান্য অভাব পূরণ করাও একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে খেতে দেয়ার মতই নেক কাজ। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা কয়েদি মুক্ত কর, ক্ষুধার্তকে খাওয়াও এবং অসুস্থদের সুশ্রুষা কর”। [বুখারী: ৩০৪৬] অনুরূপ ক্রীতদাস এবং চাকর-ভৃত্যরাও এরই অন্তর্ভুক্ত। তাদের সাথেও উত্তম ব্যবহার করার তাকীদ করা হয়েছে। নবী (সাঃ)-এর শেষ অসিয়ত এটাই ছিল যে, ‘‘তোমরা নামায এবং নিজেদের ক্রীতদাস-দাসীদের প্রতি খেয়াল রাখবে।’

 

গরীবদের খাবার দেয়ার সময় মুখে একথা বলতে হবে এমনটা জরুরী নয়। মনে মনেও একথা বলা যেতে পারে। আল্লাহর কাছে মুখে বলার যে মর্যাদা অন্তরে বলারও সে একই মর্যাদা। তবে একথা মুখে বলার উল্লেখ করা হয়েছে এ জন্য যে, যাকে সাহায্য করা হবে তাকে যেন নিশ্চিত করা যায় যে, আমরা তার কাছে কোন প্রকার কৃতজ্ঞতা অথবা বিনিময় চাই না, যাতে সে চিন্তামুক্ত হয়ে খাবার গ্রহণ করতে পারে।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) قَمْطَرِيرٌ এর অর্থ করেছেন সুদীর্ঘ। আর عَبُوْسٌ অর্থ কঠিন। অর্থাৎ, সেই দিন হবে অতীব কঠিন দিন। কঠিনতা ও ভয়াবহতার কারণে কাফেরদের জন্য তা হবে খুবই সুদীর্ঘ।

অর্থাৎ চেহারার সজীবতা ও মনের আনন্দ। অন্য কথায় কিয়ামতের দিনের সমস্ত কঠোরতা ও ভয়াবহতা শুধু কাফেরদের জন্যই নির্দিষ্ট হবে। নেককার লোকেরা সেদিন কিয়ামতের সব রকম দুঃখ-কষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে এবং আনন্দিত ও উৎফুল্ল হবে। একথাটিই অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছেঃ “চরম হতবুদ্ধিকর সে অবস্থা তাদেরকে অস্থির ও বিহবল করবে না। ফেরেশতারা অগ্রসর হয়ে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাদের গ্রহণ করবে এবং বলবে এটা তোমাদের সেদিন যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেয়া হতো।” [সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৩] এ বিষয়টিই আরেক জায়গায় আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে সে তার তুলনায় অধিক উত্তম প্রতিদান লাভ করবে। এসব লোক সেদিনের ভয়াবহতা থেকেও নিরাপদ থাকবে।” [সূরা আন-নামল: ৮৯]

 

এখানে ‘সবর’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বরং প্রকৃতপক্ষে সৎকর্মশীল ঈমানদারগণের গোটা পার্থিব জীবনকেই ‘সবর’ বা ধৈর্যের জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জ্ঞান হওয়ার বা ঈমান আনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন ব্যক্তির নিজের অবৈধ আশা আকাংখাকে অবদমিত করা, আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমাসমূহ মেনে চলা, আল্লাহর নির্ধারিত ফরযসমূহ পালন করা, হারাম পন্থায় লাভ করা যায় এরূপ প্রতিটি স্বার্থ ও ভোগের উপকরণ পরিত্যাগ করা, ন্যায় ও সত্যপ্রীতির কারণে যে ক্ষতি মৰ্মবেদনা ও দুঃখ-কষ্ট এসে ঘিরে ধরে তা বরদাশত করা-এসবই আল্লাহর এ ওয়াদার ওপর আস্থা রেখে করা যে, এ সদাচরণের সুফল এ পৃথিবীতে নয় বরং মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবনে পাওয়া যাবে। এটা এমন একটা কর্মপন্থা যা মুমিনের গোটা জীবনকেই সবরের জীবনে রূপান্তরিত করে। এটা সাৰ্বক্ষণিক সবর, স্থায়ী সবর, সর্বাত্মক সবার এবং জীবনব্যাপী সবর।

কারণ খুব গরম ও খুব শীত তো জাহান্নাম থেকে নিৰ্গত হয়। জান্নাতবাসীরা সেটা কোনক্রমেই পাবে না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করল যে, হে রব! আমার একাংশ (গরম অংশ) অপর অংশ (ঠাণ্ডা অংশ)কে শেষ করে দিল। তখন তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দেয়া হলো। একটি শীতকালে অপরটি গ্ৰীষ্মকালে। সেটাই তা তোমরা কঠিন গরম আকারে গ্ৰীষ্মকালে পাও এবং কঠিন শীত আকারে শীতকালে অনুভব করা।” [বুখারী: ৩২৬০, মুসলিম: ৬১৭]

সেখানে সূর্যের তাপ থাকবে না। তা সত্ত্বেও গাছের ছায়া তাদের প্রতি ঝুঁকে থাকবে অথবা এর অর্থ হল, গাছের শাখাগুলো তাদের অনেক কাছে হবে। গাছের ফল আজ্ঞাবহ দাসের মত অপেক্ষায় থাকবে। মানুষের যখনই তা খাবার ইচ্ছা জাগবে, তখনই তা (ফল) নুয়ে এত নিকটে হয়ে যাবে যে, তারা বসে বসে অথবা শুয়ে শুয়ে তা নিয়ে খেতে পারবে।

সূরা যুখরুফের ৭১ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের সামনে সবসময় স্বর্ণপাত্র সমূহ পরিবেশিত হতে থাকবে৷ এ থেকে জানা গেল যে,সেখানে কোন সময় স্বর্ণপাত্র এবং কোন সময় রৌপ্য পাত্র ব্যবহার করা হবে৷ তা হবে রৌপ্যের তৈরী কিন্তু কাঁচের মত স্বচ্ছ৷ এ ধরনের রৌপ্য এ পৃথিবীতে নেই৷ এটা জান্নাতের একটা বৈশিষ্ট যে, সেখানে কাঁচের মত স্বচ্ছ রৌপ্যপাত্র জান্নাতবাসীদের দস্তরখানে পরিবেশন করা হবে৷

দুনিয়ার রৌপ্য-পাত্ৰ গাঢ় ও মোটা হয়ে থাকে-আয়নার মত স্বচ্ছ হয় না। পক্ষান্তরে কাঁচ নির্মিত পাত্র রৌপ্যের মত শুভ্ৰ হয় না। উভয়ের মধ্যে বৈপরীত্য আছে, কিন্তু জান্নাতের বৈশিষ্ট্য এই যে, সেখানকার রৌপ্য আয়নার মত স্বচ্ছ হবে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ জান্নাতের সব বস্তুর নজীর দুনিয়াতেও পাওয়া যায়। তবে দুনিয়ার রৌপ্য নির্মিত গ্রাস ও পাত্র: জান্নাতের পাত্রের ন্যায় স্বচ্ছ নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার চাহিদা অনুপাতে পানপত্র ভরে ভরে দেয়া হবে। তা তাদের চাহিদার চেয়ে কম হবে না আবার বেশীও হবে না। অন্য কথায়, জান্নাতের খাদেমরা এত সতর্ক এবং সুবিবেচক হবে যে, যাকে তারা পানিপাত্র পরিবেশন করবে: সে কি পরিমাণ শরাব পান করতে চায় সে সম্পর্কে তারা পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারবে। এর আরেক অর্থ হতে পারে, জান্নাতীরা নিজেরাই তাদের ইচ্ছানুসারে যথাযথ পরিমাণ নির্ধারণ করে নিবে।

যানজাবিল এর প্রসিদ্ধ অর্থ শুকনা আদা। কাতাদা বলেন, যানজাবিল বা আদা মিশ্রিত হবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আরবরা শরাবে এর মিশ্রণ পছন্দ করত। তাই জান্নাতেও একে পছন্দ করা হয়েছে। মূলত: জান্নাতের বস্তু ও দুনিয়ার বস্তু নামেই কেবল অভিন্ন। বৈশিষ্ট্যে উভয়ের মধ্যে অনেক ব্যবধান। তাই দুনিয়ার আদার আলোকে জান্নাতের আদাকে বোঝার উপায় নেই। [ফাতহুল কাদীর] তবে মুজাহিদ বলেন, এখানে যানজাবিল বলে একটি ঝর্ণাধারাকেই বুঝানো হয়েছে, যা থেকে ‘মুকাররাবীন’ বা নৈকট্যবান ব্যক্তিগণ পান করবে।

তা হবে একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার নাম হবে ‘সালসাবীল’৷ এক হাদীসে এসেছে, জনৈক ইয়াহুদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, যখন এ যমীন ও আসমান অন্য কোন যমীন ও আসমান দিয়ে পরিবর্তিত হবে তখন মানুষ কোথায় থাকবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তারা পুলসিরাতের নিকটে অন্ধকারে থাকবে। ইয়াহুদী আবার বলল, কারা সর্বপ্রথম পার হবে? রাসূল বললেন, দরিদ্র মুহাজিরগণ। ইয়াহুদী বলল, জান্নাতে প্রবেশের সময় তাদের উপঢৌকন কি? রাসূল বললেন, মাছের পেটের কলিজা, ইয়াহুদী বলল, এরপর কি খাওয়ানো হবে? রাসূল বললেন, জান্নাতের একটি ষাঁড় তাদের জন্য জবাই করা হবে তারা তার অংশ থেকে খাবে। ইয়াহুদী বলল, তাদের পানীয় কি হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, একটি ঝর্ণাধারা থেকে যার নাম হবে সালসাবীল। মুসলিম: ৩১৫]

 

আরবরা শরাবের সাথে শুকনো আদা মেশানো পানির সংমিশ্রণ খুব পছন্দ করতো৷ তাই বলা হয়ছে ,সেখানেও তাদের এমন শরাব পরিবেশন করা হবে যাতে শুকনো আদার সংমিশ্রণ থাকবে৷ কিন্তু তা এমন সংমিশ্রন হবে না যে, তার মধ্যে শুকনো আদা মিশিয়ে তারপর পানি দেয়া হবে৷ বরং তা হবে একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার মধ্যে, আদার খোশবু থাকবে কিন্তু তিক্ততা থাকবে না৷ সে জন্য তার নাম হবে “সালসাবীল”৷ “সালসাবীল”অর্থ এমন পানি যা মিঠা, মৃদু ও সুস্বাদু হওয়ার কারণে সহজেই গলার নীচে নেমে যায়৷ অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে “সালসাবিল” শব্দটি এখানে উক্ত ঝর্ণাধারার বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ,বিশেষ্য হিসেবে নয়৷

 

শারাবের গুণ বর্ণনা করার পর তাদের গুণের কথা আলোচনা হচ্ছে, যারা পানপাত্র পেশ করবে। ‘চির-কিশোর’-এর একটি অর্থ হল, জান্নাতীদের মত এই সেবকদেরও মৃত্যু আসবে না। দ্বিতীয়ত অর্থ হল, তাদের কিশোরসুলভ বয়স ও সৌন্দর্য অব্যাহত থাকবে। তারা না বৃদ্ধ হবে, আর না তাদের রূপ-সৌন্দর্যের কোন পরিবর্তন ঘটবে।

সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সজীবতা ও সতেজতায় তারা হবে মণি-মুক্তার মত। ‘বিক্ষিপ্ত’র অর্থ, সেবার জন্য তারা চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে এবং অতি শীঘ্রতার সাথে সেবা কাজে নিরত থাকবে।

দুনিয়াতের কোন ব্যক্তি যত দরিদ্র ও নিসম্বলই হোক না কেন সে যখন তার নেক কাজের কারণে জান্নাতে যাবে তখন সেখানে এমন শানশওকত ও মর্যাদার সাথে থাকবে যেন সে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি৷

সূরা আল কাহফের ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে, “তাদের সেখানে স্বর্ণের কংকন বা চুড়ি দ্বারা সজ্জিত ও শোভিত করা হবে৷” এ একই বিষয় সূরা হজ্জের ২৩ আয়াত এবং সূরা ফাতেরের ৩৩ আয়াতেও বলা হয়েছে৷ এসব আয়াত একত্রে মিলিয়ে দেখলে তিনটি অবস্থা হওয়া সম্ভব বলে মনে হয়৷ এক, তারা ইচ্ছা করলে কোন সময় সোনার কংকন পরবে আবার ইচ্ছা করলে কোন সময় রূপার কংকন পরবে৷ তাদের ইচ্ছা অনুসারে দু”টি জিনিসই প্রস্তুত থাকবে৷ দুই, তারা সোনা ও রূপার কংকন এক সাথে পরবে৷ কারণ দুটি একত্র করলে সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি পায়৷ তিন,যার ইচ্ছা সোনার কংকন পরিধান করবে এবং যার ইচ্ছা রূপার কংকন ব্যবহার করবে৷ এখানে প্রশ্ন হলো, অলংকার পরিধান করে মেয়েরা, কিন্তু পুরুষের অলংকার পরানোর অর্থ ও তাৎপর্য কি হতে পারে? এর জবাব হলো, প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহ এবং নেতা ও সমাজপতিদের রীতি ছিল তারা হাত,গলা ও মাথার মুকুটে নানা রকমের অলংকার ব্যবহার করতো৷ আমাদের এ যুগেও বৃটিশ ভারতের রাজ ও নবাবদের মধ্যে পর্যন্ত এ রীতি প্রচলিত ছিল৷ সুরা যুখরুফে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (আ) যখন সাদাসিধে পোশাকে শুধু একখানা লাঠি হাতে নিয়ে ফেরাউনের রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে তাকে বললেন যে, তিনি বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর প্রেরিত রসূল তখন ফেরাউন তার সভসদদের বললোঃ সে এ অবস্থায় আমার সামনে এসেছে৷ দূত বটে৷ “সে যদি যমীন ও আসমানের বাদশাহর পক্ষ থেকেই প্রেরিত হয়ে থাকতো তাহলে তার সোনার কংকন নাই কেন? কিংবা ফেরেশতাদের একটি বাহিনী অন্তত তার আরদালী হয়ে আসতো৷”(আয যুখরুফ,৫৩)৷

 

শারাবান তাহুরা কি?

ইতিপূর্বে দু’প্রকার শরাবের কথা বলা হয়েছে৷ এর এক প্রকার শরাবের মধ্যে কর্পূরের সুগন্ধি যুক্ত ঝর্ণার পানি সংমিশ্রণ থাকবে৷ অন্য প্রকারের শরাবের মধ্যে “যানজাবীল, ঝর্ণার পানির সংমিশ্রন থাকবে ৷এ দুপ্রকার শরাবের কথা বলার পর এখানে আবার আর একটি শরাবের উল্লেখ করা এবং সাথে সাথে একথা বলা যে, তাদের বর তাদেরকে অত্যন্ত পবিত্র শরাব পান করাবেন এর অর্থ এই যে, এটা অন্য কোন প্রকার উৎকৃষ্টতর শরাব হবে যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে তাদের পান করানো হবে৷

মূল বাক্য হলো,  کَانَ سَعۡیُکُمۡ مَّشۡکُوۡرًا অর্থাৎ তোমাদের কাজ-কর্ম মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে৷سَعۡیُ অর্থ বান্দা সারা জীবন দুনিয়াতে যেসব কাজ-কর্ম আঞ্জাম দিয়েছে বা দেয় তা সবই৷ যেসব কাজে সে তার শ্রম দিয়েছে এবং যেসব লক্ষে সে চেষ্টা -সাধনা করেছে তার সমষ্টি হলো তারسَعۡیُ। আর তা মূল্যবান প্রমাণিত হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহ তা”আলার কাছে তা মূল্যবান বলে স্বীকৃত হয়েছে৷ শোকরিয়া কথাটি যখন বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর জন্য হয় তখন অর্থ হয় তাঁর নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা৷ আর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য হয় তখন তর অর্থ হয় আল্লাহ তা”আলা তার কাজ-কর্মের মূল্য দিয়েছেন৷ এটি মনিব বা প্রভুর একটি বড় মেহেরবানী যে, বান্দা যখন তাঁর মর্জি অনুসারে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দেয় মনিব তখন তার মূল্য দেন বা স্বীকৃতি দেন৷

ফুটনোট

* ৭৫ নং  সূরা কিয়ামাহ ‘ইনসান’ শব্দটি ৬বার উল্লেখ করার হয়েছে আর এ সূরা প্রথম আয়াতেই ইনসান শব্দ এসেছে। এবং এ সূরার নামই সূরা ইনসান।

* নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আহর দিন ফজরের সালাতে সূরা আস সেজদাহ্ এবং সূরা আদ-দাহর দু’টি সূরাহ্ তিলাওয়াত করতেন।

* এমনও সময় ছিল যখন মানুষ উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না, আল্লাহ্‌ তায়ালাই তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আমরা ভালো করে আত্মসমালোচনা করা উচিত। আমাদের চলা-ফেরায় যে দাম্ভিকতা থাকে, ব্যবহারে অহংকার যে থাকে, একদিন যখন দুনিয়ার এই জীবন শেষ হবে তখন আমাদের সৃষ্টিকর্তার সামনে কিভাবে দাড়াবো?

*  মানুষকে সৃষ্টি করে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন পরীক্ষার জন্য আর পরীক্ষার উপযুক্ত হওয়ার জন্য দান করেছনে-

তাকে سَمِیۡعًۢا ও بَصِیۡرًا অর্থাৎ “শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি” কথাটি বলার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ তা”আলা তাকে জ্ঞান ও বিবেক -বুদ্ধির শক্তি দিয়েছেন যাতে সে পরীক্ষা দেয়ার উপুযুক্ত হতে পারে৷

* আল্লাহ্‌ আমাদের শুধু জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই ছেড়ে দেইনি বরং এগুলো দেয়ার সাথে সাথে আমাদের  পথও দেখিয়েছি। যাতে আমরা জানতে পারে শোকরিয়ার পথ কোনটি এবং কুফরীর পথ কোনটি। এরপর যে পথই সে অবলম্বন করুক না কেন তার জন্য আমরা নিজেই দায়ী।

* জান্নাতীদের জন্য তিন ধরনের পানীয়র কথা এই সূরায় উল্লেখ আছে-

১. কর্পূরের সুগন্ধি যুক্ত ঝর্ণার পানি

২. যানজাবিল বা আদা মিশ্রিত পানি

৩. শারাবান তাহুরা (পবিত্র শরাব)

* জান্নাতের একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারা যার নাম হবে ‘সালসাবীল’৷

* জান্নাতীদের জন্য অনেক পুরস্কার ও নিয়ামতের কথা উল্লেখ আছে সেগুলো হলো-

১. তিনধরনের পানীয় ও সালসাবিল নামক ঝর্ণা থাকবে

২. হাস্যোজ্জ্বলতা ও উৎফুল্লতা

৩. উদ্যান ও রেশমী বস্ত্ৰ

৪. সুসজ্জিত আসন

৫. আরামদায়ক আবহাওয়া ( সেখানে খুব গরম অথবা খুব শীত দেখবে না)

৬. গাছের ছায়া এবং ফলমূল

৭. রূপালী স্ফটিক-পাত্র

৮. স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিশাল রাজ্য

৯. তাদের উপর প্রদক্ষিণ করবে চির কিশোরগণ

১০. তাদের আবরণ সূক্ষ্ম সবুজও স্থূল রেশম, এবং  অলংকৃত হবে রৌপ্য নির্মিত কংকনে,

* জান্নাতের আধিবাসী কারা হবে তাদের পরিচয় অন্যভাবে বললে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ করে জান্নাতে যেতে হলে করণীয় কি তা এ সূরা উল্লেখ করা হয়েছে-

১. তারা আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে

২. তারা মান্নত পূর্ণ করে

৩. তারা কিয়ামত দিবসের ভয় রাখে

৪. তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে অন্নদান করে।

৫. তারা সবর বা ধৈর্যধারণ করে

* এই সূরায় অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে অন্নদান করা কথা বলার পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আল্লাহ্‌র রাব্বুল আলামীন সংযুক্ত করে দিয়েছেন-

১. নিজেদের খাবারের প্রয়োজন থাকার পরও অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীকে অন্নদান করে।

২. একমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দ্যেশে খাবার দান করে

৩. কোনো ধরনের প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতার পাওয়ার আশা রাখে না।

* এখানে তিন শ্রেণির মানুষকে খাবার দান করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দী।

সর্বশেষ ২২নং আয়াত টি হলো আমাদের এই নোটের মেসেজ- জান্নাতীদের তাদের পুরস্কার দিয়ে বলা হবে- ‘নিশ্চয় এটা তোমাদের পুরস্কার; আর তোমাদের কর্মপ্রচেষ্টা ছিল প্ৰসংশাযোগ্য।’ চিন্তা করুন তো আমরা যে কর্ম প্রচেষ্টা করছি সেগুলো কি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টী লাভের জন্য যথেষ্ট? সেগুলো আদৌ প্রসংশারযোগ্য মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে? আমরা কি পারছি আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞতা আদায় করতে, ওয়াজিব কাজগুলো পালন করতে, খাবার দান করতে, কিয়ামতের ভয় মনের মধ্যে রাখতে, ধৈর্যধারণ করতে?

 

আসুন, আমরা চেষ্টার করি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দোশ্যে কাজগুলোর করার। তাহলে হয়তো আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আমরা জান্নাতের নিয়ামতগুলো উপভোগ করতে পারবো।