Notes 16- Sura Maryam 1 to 15 Ayat

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ১৬

সূরা মারইয়াম (১-১৫)    

কুরআনের ১৯ নম্বর সূরা; এর আয়াত সংখ্যা ৯৮ এবং রূকু সংখ্যা ৬। সূরা মারইয়াম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। মারইয়াম আঃ হলেন ঈসা আঃ এর মাতা।

নামকরণ

এই সূরাটির ষোড়শ আয়াতের وَاذْكُرْفِيالْكِتَبِ مَرْيَمَ বাক্যাংশ থেকে এই সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

হাবশায় হিজরাতের আগেই সূরাটি নাযিল হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে জানা যায়, মুসলিম মুহাজিরদরকে যখন হাবশায় শাসক নাজ্জাশীর দরবারে ডাকা হয় তখন হযরত জাফর দরবারে উপস্থিত হয়ে এ সূরাটি তেলওয়াত করেন।

আলোচ্য বিষয় ও কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু

এ ঐতিহাসিক পটভূমির প্রতি দৃষ্টি রেখে যখন আমরা এ সূরাটি দেখি তখন এর মধ্যে সর্ব প্রথম যে কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে আমাদের সামনে আসে সেটি হচ্ছে এই যে, যদিও মুসলমানরা একটি মজলুম শরণার্থী দল হিসেবে নিজেদের স্বদেশভূমি ত্যাগ করে অন্যদেশে চলে যাচ্ছিল তবুও এ অবস্থায়ও আল্লাহ তাদেরকে দীনের ব্যাপারে সামান্যতম আপোস করার শিক্ষা দেননি। বরং চলার সময় পাথেয় স্বরূপ এ সূরাটি তাদের সাথে দেন, যাতে ঈসায়ীদের দেশে তারা ঈসা আলাইহিস সালামের একেবারে সঠিক মর্যাদা তুলে ধরেন এবং তাঁর আল্লাহর পুত্র হওয়ার ব্যাপারটা পরিস্কারভাবে অস্বীকার করেন।

প্রথম দু’ রুকূ’তে (১-৪০ আয়াত) হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ) ও হযরত ঈসা (আ) এর কাহিনী শুনাবার পর আবার তৃতীয় রুকূতে (৪১-৫০আয়াত) সমকালীন অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে হযরত ইবরাহীমের (আ) কাহিনী শুনানো হয়েছে। কারণ এ একই ধরনের অবস্থায় তিনিও নিজের পিতা, পরিবার ও দেশবাসীর জুলুম নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করেছিলেন। এ থেকে একদিকে মক্কার কাফেরদেরকে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, আজ হিজরতকারী মুসলমানরা ইবরাহীমের পর্যায়ে রয়েছে এবং তোমরা রয়েছো সেই জালেমদের পর্যায়ে যারা তোমাদের পিতা ও নেতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে গৃহত্যাগী করেছিল। অন্যদিকে মুহাজিরদের এ সুখবর দেয়া হয়েছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেমন স্বদেশ ত্যাগ করে ধ্বংস হয়ে যাননি বরং আরো অধিকতর মর্যাদাশীল হয়েছিলেন তেমনি শুভ পরিণাম তোমাদের জন্য অপেক্ষা করেছে।

এরপর চতুর্থ রুকূতে (৫১-৬৫) অন্যান্য নবীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে একথা বলাই উদ্দেশ্য যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দীনের বার্তা বহন করে এনেছেন সকল নবীই সেই একই দীনের বার্তাবহ ছিলেন। কিন্তু নবীদের তিরোধানের পর তাঁদের উম্মতগণ বিকৃতির শিকার হতে থেকেছে। আজ বিভিন্ন উম্মতের মধ্যে যেসব গোমরাহী দেখা যাচ্ছে এগুলো সে বিকৃতিরই ফসল।

শেষ দু’ রুকূতে (৬৬-৯৮ আয়াত) মক্কার কাফেরদের ভ্রষ্টতার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে এবং কথা শেষ করতে গিয়ে মু’মিনদেরকে এই মর্মে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, সত্যের শত্রুদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তোমরা জনগণের প্রিয় ভাজন হবেই।

সূরার ফযীলত

ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, সূরাহ বনী ইসরাঈল, কাহাফ এবং মারইয়াম প্রথমে নাযিল হওয়া অতি উত্তম সূরা। এগুলো আমার পুরানো রক্ষিত সম্পদ। (বুখারী ৪৩৪৮)

পূর্ববর্তী সূরার সাথে সম্পর্ক

পূর্ববর্তী সূরায় অনেক বিস্ময়কর ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে। যেমন আসহাবে কাহফ, জুলকারনাইন, ইয়াজুজ মাজুক প্রভৃতি । এই সূরায়ও কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। যেমন, হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া এবং তার ফলশ্রুতিতে হযরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর জন্মের ঘটনা এই সূরায় স্থান পেয়েছে। এতদ্যতীত অন্যান্য আস্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলিও এই সূরায় উল্লিখিত হয়েছে। এর দ্বারা তাওহীদ বা আল্লাহ তা“আলার একতৃবাদ, প্রিয়নবী -এর রেসালাত, দুনিয়ার এই জীবন ও পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনের অনেক জরুরি কথা ইরশাদ হয়েছে। এসব ঘটনা দ্বারা পবিত্র কুরআন বিশ্ব মানবকে এই সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছে যে, দেখ যারা আল্লাহ তা“আলার বিধান মেনে চলে, আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি কত বরকত নাজিল করেন, আর কত নিয়ামত তিনি তাদেরকে দান করেন । অতএব তোমাদের কর্তব্য হলো, আল্লাহ তা’আলার নেককার বান্দাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা । কেননা, এ জীবন ও পরজীবনের সাফল্য এতেই রয়েছে নিহিত।

সূরা কাহাফে ইতিহাসের একটি বিস্বয়কর ঘটনা বর্ণিত হয়েছিল। সূরা মারইয়ামেও এমনি ধরনের অত্যাশ্চ্য একটি বিষয়বন্তু সন্নিবেশিত হয়েছে। সম্ভবত এ সম্পর্কের কারণেই সূরা কাহাফের পরে সূরা মারইয়ামকে স্থান দেওয়া হয়েছে।

এ হরফগুলোকে কুরআনের পরিভাষায় হরফে মুকাত্তা’আত’ বলা হয়। উনত্রিশটি সূরার প্রারম্ভে এ ধরনের হরফে মুকাত্তা’আত ব্যবহার করা   হয়েছে। এগুলোর অর্থের ব্যাপারে কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নেই। আল্লাহই এর অর্থ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত। এগুলো মুতাশাবিহাত বা অস্পষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত।

এখানে যে হযরত যাকারিয়ার কথা আলোচনা করা হচ্ছে তিনি ছিলেন হযরত হারুনের বংশধর৷ তাঁর মর্যাদা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে বনী ইসরাঈলের যাজক ব্যবস্থা (Priesthood) সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে হবে৷ ফিলিস্তিন দখল করার পর বনী ইসরাঈল দেশের শাসন ব্যবস্থা এমনভাবে সংঘটিত করেছিল যার ফলে হযরত ইয়াকুবের (আ) সন্তানদের ১২টি গোত্রের মধ্যে সমগ্র দেশ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং ১৩তম গোত্রটি(অর্থাৎ লাভী ইবনে ইয়াকুবের গোত্র) ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল৷ আবার বনী লাভীর মধ্যেও যে পরিবারটি বাইতুল মাকদিসে খোদাবন্দের সামনে ধূপ জ্বালাবার দায়িত্ব পালন এবং পবিত্রতম জিনিসসমূহের পবিত্রতা বর্ণনা করার কাজ করতো তারা ছিল হযরত হারুনের বংশধর৷ বনী লাভীর অন্যান্য লোকেরা বাইতুল মাকদিসের মধ্যে যেতে পারতো না বরং আল্লাহর গৃহের পরিচর্যার সময় আঙ্গিনায় ও বিভিন্ন কক্ষে কাজ করতো৷ শনিবার ও ঈদের সময় কুরবানী করতো এবং বাইতুল মাকদিসের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে বনী হারুনকে সাহায্য করতো৷ বনী হারুনের চব্বিশটি শাখা ছিল৷ তারা পালাক্রমে বাইতুল মাকদিসের সেবায় হাযির হতো৷ এই শাখাগুলোর মধ্যে একটি ছিল আবইয়াহর শাখা৷ এর সরদার ছিলেন হযরত যাকারিয়া৷ নিজের গোত্রের পালার দিন তিনিই মাকদিসে যেতেন এবং আল্লাহর সমীপে ধূপ জ্বালাবার দায়িত্ব পালন করতেন৷

গোপনে আহবান বা দু’আ এই জন্যই করেছিলেন যে, প্রথমতঃ এইভাবে দু’আ আল্লাহর নিকট বেশী পছন্দনীয়। কারণ এর মধ্যে কাকুতি-মিনতি বেশী প্রকাশ পায়। দ্বিতীয়তঃ লোকে যাতে তাকে বোকা না ভাবে যে, এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তান চাচ্ছে; যখন সন্তান হওয়ার সকল প্রকার বাহ্যিক সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।

অস্থির দুর্বলতা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, অস্থিই দেহের খুঁটি। অস্থির দুর্বলতা সমস্ত দেহের দুর্বলতার নামান্তর।

اشتعل এর শাব্দিক অর্থ, প্রজ্জ্বলিত হওয়া, এখানে চুলের শুভ্রতাকে আগুনের আলোর সাথে তুলনা করে তা সমস্ত মস্তকে ছড়িয়ে পড়া বোঝানো হয়েছে।

এখানে দো’আর পূর্বে যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম তার দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি কারণ এই যে, এমতাবস্থায় সন্তান না আসাই স্বাভাবিক। এখানে দ্বিতীয় কারণ এটাও যে, দোআ করার সময় নিজের দুর্বলতা, দুর্দশা ও অভাবগ্রস্থতা উল্লেখ করা দো’আ কবুল হওয়ার পক্ষে সহায়ক। তারপর বলছেন যে, আপনাকে ডেকে আমি কখনও ব্যৰ্থ হইনি। আপনি সবসময় আমার দোআ কবুল করেছেন।

সূরা ইমরানে উল্লেখ আছে যাকারিয়া আঃ দোয়া করেছিলেন-

قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ

হে আমার রব! তোমরা বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে সৎ সন্তান দান করো৷ তুমিই প্রার্থনা শ্রবণকারী’’৷ (আয়াত- ৩৮)

এই আশংকার অর্থ এই যে, যদি আমার কোন উত্তরাধিকারী আমার ওয়ায ও উপদেশের দায়িত্ব গ্রহণ না করে, তাহলে আমার স্বগোত্রীয় আত্মীয়দের মধ্যে তো কেউ এর যোগ্য নেই। আর এর ফলস্বরূপ হয়তো আমার আত্মীয়রা তোমার রাস্তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

‘তোমার নিকট হতে’ এর অর্থ যদিও আমার বাহ্যিক সন্তান-সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে, তবুও তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একটি সন্তান দান কর। (যে আমার ওয়ারেস ও উত্তরাধিকারী হবে।)

আলেমদের মতে, এখানে উত্তরাধিকারিত্বের অর্থ নবুওয়াত-রিসালত তথা ইলমের উত্তরাধিকার। আর্থিক উত্তরাধিকারিত্ব নয়। কেননা, প্রথমতঃ যাকারিয়্যার কাছে এমন কোন অর্থ সম্পদ ছিল বলেই প্রমাণ নেই, যে কারণে চিন্তিত হবেন যে, এর উত্তরাধিকারী কে হবে। একজন পয়গম্বরের পক্ষে এরূপ চিন্তা করাও অবান্তর। এছাড়া যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম নিজে কাঠ-মিস্ত্রি ছিলেন। নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাঠ-মিস্ত্রির কাজের মাধ্যমে এমন সম্পদ আহরণ করা সম্ভব হয় না যার জন্য চিন্তা করতে হয়।

দ্বিতীয়ত: সাহবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য সম্বলিত এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ “নিশ্চিতই আলেমগণ পয়গম্বরগণের ওয়ারিশ। পয়গম্বরগণ কোন দীনার ও দিরহাম রেখে যান না; বরং তারা ইলম ও জ্ঞান ছেড়ে যান। যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে, সে বিরাট সম্পদ হাসিল করে।”- [আবু দাউদ: ৩৬৪১, ইবনে মাজহ: ২২৩, তিরমিযী: ২৬৮২]

তৃতীয়ত: স্বয়ং আলোচ্য আয়াতে এর (يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ) বাক্যের যোগ এরই প্রমাণ যে, এখানে আর্থিক উত্তরাধিকারিত্ব বোঝানো হয়নি। কেননা, যে পুত্রের জন্মলাভের জন্যে দোআ করা হচ্ছে, তার পক্ষে ইয়াকুব আলাইহিস সালামের উত্তরাধিকার হওয়াই যুক্তিযুক্ত কিন্তু তাদের নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনরা যাদের উল্লেখ আয়াতে করা হয়েছে, তারা নিঃসন্দেহে আত্মীয়তায় ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম থেকে অধিক নিকটবর্তী। নিকটবর্তী আত্মীয় রেখে দূরবর্তীর উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করা উত্তরাধিকার আইনের পরিপন্থী।

سَمِيًّا শব্দের অর্থ সমনামও হয় এবং সমতুল্যও হয়। এখানে প্রথম অর্থ নেয়া হলে আয়াতের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট যে, তার পূর্বে ইয়াহইয়া নামে কারও নামকরণ করা হয়নি। নামের এই অনন্যতা ও অভূতপূর্বতাও কতক বিশেষ গুণে তাঁর অনন্যতার ইঙ্গিতবহ ছিল। কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ ইয়াহইয়া অর্থ জীবিতকরণ, তিনি এমন এক বান্দা যাকে আল্লাহ ঈমানের মাধ্যমে জীবন্ত রেখেছিলেন।

পক্ষান্তরে যদি দ্বিতীয় অর্থ নেয়া হয় তখন উদ্দেশ্য হবে, তার মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা তার পূর্ববর্তী নবীগণের কারও মধ্যে ছিল না। সেসব বিশেষ গুণে তিনি তুলনাহীন ছিলেন। এতে জরুরী নয় যে, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম পূর্ববর্তী নবীদের চাইতে সর্বাবস্থায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কেননা, তাদের মধ্যে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ ও মূসা কলীমুল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত ও সুবিদিত।

عاقِر ঐ মহিলাকে বলা হয় যে বার্ধক্যের কারণে সন্তান জন্মাতে সক্ষম নয়, আর ঐ মহিলাকেও বলা যায়, যে প্রথম হতেই বন্ধ্যা। এখানে দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যে কাঠ শুকিয়ে যায় তাকে عِتي বলা হয়। এখানে অর্থ বার্ধক্যের শেষ পর্যায়, যখন শরীরের গোশত শুকিয়ে যায়। বলার উদ্দেশ্য হল, আমার স্ত্রী তো যৌবন কাল হতেই বন্ধ্যা, আর আমিও বৃদ্ধ ব্যক্তি। এখন আমাদের সন্তান হবে কিভাবে? কথিত আছে যাকারিয়া (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম ছিল আশা’ বিনতে ফাক্বূদ বিন মীল। ইনি ছিলেন মারয়্যামের মা হান্নার বোন। কিন্তু সঠিক কথা হল আশা’ও মারয়্যামের পিতা ইমরানেরই কন্যা ছিলেন। অতএব (মারয়্যাম ও আশা’ দুই বোন এবং) য়্যাহয়্যা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) আপোসে খালাতো ভাই। যেমন সহীহ হাদীসেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

হযরত যাকারিয়া আঃ এর প্রশ্ন  اَنّٰی (কিভাবে হবে) এর দ্বারা আল্লাহর কুদরতকে অস্বীকৃতির অর্থ বুঝায় না। বরং এই প্রশ্নের অর্থ কৌতুহলবশত জানার চেষ্টা করা যে, কিভাবে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, আমাদের উভয়ের যৌবন প্রদান করা হবে অথবা আমরা উভয়ে বৃদ্ধই থাকবো আর এভাবেই শিশু জন্মগ্রহণ করবে।

হযরত যাকারিয়ার এই প্রশ্ন এবং ফেরেশতাদের জবাব সামনে রাখুন৷ কারণ সামনের দিকে হযরত মারয়ামের কাহিনীতে এ বিষয়বস্তু আবার আসছে এবং এখানে এর যে অর্থ সেখানেও সেই একই অর্থ হওয়া উচিত৷ হযরত যাকারিয়া বলেন, আমি একজন বৃদ্ধ এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, আমার ছেলে হতে পারে কেমন করে! ফেরেশতারা জবাব দেন, “এমনিই হবে”৷ অর্থাৎ তোমার বার্ধক্য ও তেমার স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও তোমার ছেলে হবে৷ তারপর ফেরেশতা আল্লাহর কুদরাতের বরাত দিয়ে বলেন, যে আল্লাহ তোমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন, তোমার মত খুনখুনে বুড়োর ঔরসে আজীবন বন্ধ্যা এক বৃদ্ধার গর্ভে জন্ম দেয়া তার কুদরাতের অসাধ্য নয়৷  এভাবে আল্লাহ্ তা’আলা সবকিছুকেই অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্বে নিয়ে আসেন। এর জন্য শুধু তাঁর ইচ্ছাই যথেষ্ট। মহান আল্লাহ বলেনঃ “মানুষ কি স্মরণ করে না যে, আমরা তাকে আগে সৃষ্টি করেছি। যখন সে কিছুই ছিল না?” [সূরা মারইয়াম: ৬৭] আরও বলেনঃ “কালপ্রবাহে মানুষের উপর তো এমন এক সময় এসেছিল যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না।” [সূরা আল-ইনসান: ১]

سَوِيًّا শব্দের অর্থ সুস্থ। শব্দটি একথা বোঝানোর জন্য যুক্ত করা হয়েছে যে, যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম এর কোন মানুষের সাথে কথা না বলার এ অবস্থাটি কোন রোগবশতঃ ছিল না। এ কারণেই আল্লাহর যিকর ও ইবাদতে তার জিহবা তিন দিনই পূর্ববৎ খোলা ছিল; বরং এ অবস্থা মু’জেযা ও গর্ভসঞ্চারের নিদর্শন স্বরূপই প্রকাশ পেয়েছিল। [ইবন কাসীর]

سَوِيًّا শব্দের অর্থ সুস্থ। শব্দটি একথা বোঝানোর জন্য যুক্ত করা হয়েছে যে, যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম এর কোন মানুষের সাথে কথা না বলার এ অবস্থাটি কোন রোগবশতঃ ছিল না। এ কারণেই আল্লাহর যিকর ও ইবাদতে তার জিহবা তিন দিনই পূর্ববৎ খোলা ছিল; বরং এ অবস্থা মু’জেযা ও গর্ভসঞ্চারের নিদর্শন স্বরূপই প্রকাশ পেয়েছিল। [ইবন কাসীর]

মেহরাব শব্দটি বলার সাথে সাথে লোকদের দৃষ্টি সাধারণত আমাদের দেশে মসজিদে ইমামের দাঁড়াবার জন্য যে জায়গাটি তৈরী করা হয় সেদিকে চলে যায়৷ কিন্তু এখানে মেহরাব বলতে সে জায়গাটি বুঝানো হয় নি৷ খৃষ্টান ও ইহুদীদের গীর্জা ও উপাসনালয়গুলোতে মূল উপাসনা গৃহের সাথে লাগোয়া ভূমি সমতল থেকে যথেষ্ট উঁচুতে যে কক্ষটি তৈরী করা হয়, যার মধ্যে উপাসনালয়ের খাদেম, পুরোহিত এতেকাফকারীরা অবস্থান করে, তাকে মেহরাব বলা হয়৷ এই ধরনের একটি কামরায় হযরত মারয়াম এতেকাফ করছিলেন৷

সকাল-সন্ধ্যায় পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা বা তসবীহ করার অর্থঃ আসরের ও ফজরের নামায পড়া। অথবা এর অর্থঃ সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তসবীহতে বেশী মনোযোগী হও।

حنان শব্দটি মমতার প্রায় সমার্থক শব্দ। আল্লাহ তার জন্য মায়া-মমতা ঢেলে দিয়েছিলেন। আল্লাহও তাকে ভালবাসতেন। তিনিও আল্লাহর বান্দাদেরকে ভালবাসতেন। একজন মায়ের মনে নিজের সন্তানের জন্য যে চূড়ান্ত পর্যায়ের স্নেহশীলতা থাকে, যার ভিত্তিতে সে শিশুর কষ্টে অস্থির হয়ে পড়ে, আল্লাহর বান্দাদের জন্য ইয়াহইয়ার মনে এই ধরনের স্নেহ-মমতা সৃষ্টি হয়েছিল।

زَکٰوۃً শব্দ দ্বারা এখানে অন্তরের পবিত্রতা বুঝানো হয়েছে যেন গুনাহের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া থেকে অন্তর পবিত্র থাকে। কোনো তাফসীরবিদ বলেন, زَکٰوۃً শব্দ দ্বারা নেক আমল বুঝানো হয়েছে।

অর্থাৎ, পিতা-মাতা বা নিজ প্রতিপালকের অবাধ্য ছিলেন না। এর অর্থ হল, যদি আল্লাহ তাআলা কারো অন্তরে পিতা-মাতার প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, তাঁদের আনুগত্য ও খিদমত, তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার বা সদাচার করার শক্তি দান করেন তাহলে তা হবে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ। সুতরাং যদি এর বিপরীত চরিত্র কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে তা হল আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চনার ফল।

অর্থাৎ, পিতা-মাতা বা নিজ প্রতিপালকের অবাধ্য ছিলেন না। এর অর্থ হল, যদি আল্লাহ তাআলা কারো অন্তরে পিতা-মাতার প্রতি ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, তাঁদের আনুগত্য ও খিদমত, তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার বা সদাচার করার শক্তি দান করেন তাহলে তা হবে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ। সুতরাং যদি এর বিপরীত চরিত্র কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে তা হল আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চনার ফল।

ফুটনোট 

সুফইয়ান ইবনে উয়াইনাহ বলেন, তিন সময়ে মানুষ সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়।

এক. যখন সে দুনিয়াতে প্রথম আসে। কারণ সে তাকে এক ভিন্ন পরিবেশে আবিস্কার করে।
দুই. যখন সে মারা যায়। কারণ সে তখন এমন এক সম্প্রদায়কে দেখে যাদেরকে দেখতে সে অভ্যস্ত নয়।
তিন. হাশরের মাঠে; কারণ তখন সে নিজেকে এক ভীতিপ্রদ অবস্থায় জমায়েত দেখতে পায়।

তাই ইয়াহইয়া ইবন যাকারিয়্যা আলাইহিস সালামকে এ তিন বিপৰ্যয়কর অবস্থার বিভিষিকা থেকে নিরাপত্তা প্ৰদান করেছেন।