কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২
প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ২২
সূরা কাহাফ (১-১৭)
কুরআনের ১৮ তম সূরা৷ এর আয়াত সংখ্যা ১১০ টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ১২ টি। আল কাহফ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। কাহাফ শব্দের অর্থ গুহা।
নামকরণ
প্রথম রুকূ’র ৯ আয়াত থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে । এ নাম দেবার মানে হচ্ছে এই যে, এটা এমন একটা সূরা যার মধ্যে আল কাহফ শব্দ এসেছে ।
শানে নুযুল
আল্লামা ইবনে কাছীরসহ অন্যান্য মুফাসসিরে কেমরাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, মক্কার কুরাইশরা নযর বিন হারিছ এবং উকবা বিন আবু মঈতকে মদীনার ইহুদী আলেমদের কাছে পাঠাল। তারা তাদের উভয়কে বললঃ তোমরা মদীনায় যাও এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর। তোমার তাদেরকে মুহাম্মাদের গুণাগুণ সম্পর্কেও বল এবং সে যা বলছে, সে সম্পর্কেও তাদেরকে খবর দাও। কেননা তারা আহলে কিতাব। তাদের কাছে নবী-রাসূলদের সম্পর্কে এমন জ্ঞান আছে, যা আমাদের কাছে নেই।
সুতরাং নযর বিন হারিছ এবং উকবাহ মদীনায় গিয়ে ইহুদী আলেমদের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তারা ইহুদী আলেমদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বৈশিষ্ট এবং তাঁর কিছু খবরাদিও বর্ণনা করল। পরিশেষে তারা বললঃ তোমরা তাওরাতের অধিকারী। তাই আমরা তোমাদের কাছে আমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। সুতরাং আমাদেরকে তার সম্পর্কে কিছু সংবাদ দাও এবং এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দাও, যার দ্বারা আমরা তাঁকে পরীক্ষা করতে পারি।
এবার ইহুদী আলেমরা তাদেরকে বললঃ তোমরা তাঁকে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সে যদি প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারে, তাহলে সে সত্য নবী। আর যদি উত্তর দিতে না পারে, তাহলে বুঝবে যে, সে একজন মিথ্যুক। তোমরা তার ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করতে পার।
১) তোমরা তাকে ঐ সমস্ত যুবকদের সম্পর্কে (আসহাবে কাহাফ) জিজ্ঞেস কর, যারা অতীত কালে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করেছিল। তাদের অবস্থা কি হয়েছিল? কেননা তাদের ঘটনাটি ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।
২) তোমরা তাকে আল্লাহর সেই মুমিন বান্দা (যুল কারনাইন) সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের সব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তার খবর কি ছিল?
৩) তোমরা তাঁকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। এটি কি?
সে যদি তোমাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে, তাহলে সে একজন সত্য নবী। তার অনুসরণ কর। আর উত্তর দিতে না পারলে মনে করবে সে একজন মিথ্যুক। অতঃপর তোমরা তার ব্যাপারে যে কোন সিদ্বান্ত নিতে পার।
প্রশ্নগুলো নিয়ে নযর এবং উকবাহ মক্কার কুরাইশদের নিকট ফেরত আসল। তারা কুরাইশদেরকে বললঃ আমরা মুহাম্মাদ ও তোমাদের মাঝে ফয়সালাকারী একটি বিষয় নিয়ে এসেছি। এই বলে তারা প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কুরাইশদেরকে জানাল এবং বললঃ মদীনার ইহুদী আলেমগণ আমাদেরকে বলেছে, আমরা যেন প্রশ্নগুলো মুহাম্মাদের সামনে পেশ করি। সুতরাং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আগমণ করল এবং উপরোক্ত তিনটি প্রশ্ন করল। তিনি বললেনঃ আগামীকাল আমি তোমাদেরকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব। কিন্তু তিনি ইনশা-আল্লাহ্ বলতে ভুলে গেলেন। কাফেররা আগামীকালের ওয়াদা নিয়ে চলে গেল। ইনশা-আল্লাহ্ না বলার কারণে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও এ ব্যাপারে কোন অহী আসল না এবং জিবরীলও আগমণ করলনা।
ঐ দিকে মক্কার কুরাইশরা বলাবলি করতে লাগলঃ মুহাম্মাদ আগামীকালের ওয়াদা করেছে। আর আজ পনের দিন হল। এখন পর্যন্ত আমাদের প্রশ্নগুলোর কোন উত্তরই দিতে পারে নি। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তিত হলেন এবং বিষয়টি তাঁর কাছে কঠিন আকার ধারণ করল। অতঃপর পনের দিন পর জিবরীল সূরা কাহাফসহ অবতীর্ণ হলেন। তাতে আসহাবে কাহাফের ঘটনা, যুল কারনাইন বাদশার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং রূহের তথ্যও উল্লেখ করা রয়েছে।
সূরা কাহাফের চার কাহিনী
এই সূরার মধ্যে চারটি কাহিনী বর্ণিত আছে। এই চারটি কাহিনীর মধ্যেই আমাদের জন্য একটি করে মৌলিক শিক্ষা রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে এই চারটি কাহিনী বর্ণনা করা হল।
১. আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীদের কাহিনী- বিশ্বাসের পরীক্ষা
এটি একদল যুবকের কাহিনী যারা নিজেদের ঈমানকে রক্ষার জন্য নিজেদের ঘর ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে পর্বতের গুহাবাসী হয়েছিল। গুহায় আশ্রয় নেওয়ার পর তারা ঘুমিয়ে পড়লে আল্লাহ তাদেরকে ৩০০ বছর ঘুমের মধ্যে রাখেন।
৩০০ বছর পর ঘুম থেকে তারা জেগে তাদের মধ্যে একজনকে শহর থেকে খাবার আনার জন্য পাঠালেন। তারা চিন্তা করেছিলেন, তারা হয়তো একদিন বা তার থেকে কম সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন।
খাবার আনতে যাওয়া ব্যক্তি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শহরের বাজারে যান, যাতে করে কেউ তাকে চিনে তার ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একদল মানুষের মাঝে আবিষ্কার করেন এবং দোকানদার তার কাছে পুরাতন মুদ্রা পেয়ে তাকে পাকড়াও করে, মুদ্রা গুলো তিনি কোথায় পেয়েছেন জানতে চেয়ে।
মূলত এই কাহিনীতে দেখানো হয়েছে, আল্লাহ তার উপর ভরসাকারী বান্দাদেরকে কি করে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। বাইবেলে এই কাহিনীটি এফসুসের সাত ঘুমন্ত ব্যক্তি শিরোনামে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়,
“আপনি কি ধারণা করেন যে, গুহা ও গর্তের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকরা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয়গ্রহণ করে তখন দোআ করে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে নিজের কাছ থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্যে আমাদের কাজ সঠিকভাবে পূর্ণ করুন। তখন আমি কয়েক বছরের জন্যে গুহায় তাদের কানের উপর নিদ্রার পর্দা ফেলে দেই।” (সূরা কাহাফ, আয়াত: ৯-১১)
শিক্ষাঃ ঈমানের উপর পরীক্ষা।
২. দুই বাগানের মালিকের কাহিনী- সম্পদের পরীক্ষা
“আপনি তাদের কাছে দুই ব্যক্তির উদাহরণ বর্ণনা করুন। আমি তাদের একজনকে দুটি আঙ্গুরের বাগান দিয়েছি এবং এ দুটিকে খেজুর গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছি এবং দুইয়ের মাঝখানে করেছি শস্যক্ষেত্র। উভয় বাগানই ফলদান করে এবং তা থেকে কিছুই হ্রাস করত না এবং উভয়ের ফাঁকে ফাঁকে আমি নহর প্রবাহিত করেছি। সে ফল পেল। অতঃপর কথা প্রসঙ্গে সঙ্গীকে বলল, আমার ধন-সম্পদ তোমার চাইতে বেশী এবং জনবলে আমি অধিক শক্তিশালী।” (সূরা কাহাফ, আয়াত: ৩২-৩৪)
ধনবান লোকটি তার সম্পদের জন্য আল্লাহর শোকর করতে ভুলে গিয়ে নিজেই অহংকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। ফলে আল্লাহ তার বাগানকে ধ্বংস করে দেন। এই কাহিনী তাদের জন্য শিক্ষণীয়, যারা দুনিয়ার সম্পদ পেয়ে আল্লাহকে ভুলে যায় এবং অহংকারে লিপ্ত হয়।
শিক্ষাঃ সম্পদের উপর পরীক্ষা।
৩. মুসা ও খিজির (আ.) এর কাহিনী- জ্ঞানের পরীক্ষা
হাদীসে এসেছে, একবার হযরত মুসা (আ.) বনী ইসরাইলের সমাবেশে তাদের হেদয়াতের জন্য কথা বলছিলেন। এসময় তাকে প্রশ্ন করা হল, দুনিয়া সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “আমি।” মুসা (আ.) এর উত্তরের জন্য আল্লাহ তাকে তিরস্কার করেন এবং বলেন, দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আল্লাহর এক বান্দা আছে। মুসা (আ.) তার সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আল্লাহ তখন তার বান্দা খিজির (আ.) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য নির্দেশনা দান করেন।
কুরআনে বলা হয়েছে, “অতঃপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেলেন, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মূসা তাঁকে বললেন, আমি কি এ শর্তে আপনার অনুসরণ করতে পারি যে, সত্যপথের যে জ্ঞান আপনাকে শেখানো হয়েছে, তা থেকে আমাকে কিছু শিক্ষা দেবেন?” (সূরা কাহাফ, আয়াত: ৬৫-৬৬)
এখানে মূলত আল্লাহ জ্ঞানের প্রকাশে বিনীত হতে এবং তা নিয়ে কখনো অহংকারের প্রকাশ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা প্রদান করেছেন।
শিক্ষাঃ জ্ঞানের উপর পরীক্ষা।
৪. যুলকারনাইনের কাহিনী- ক্ষমতার পরীক্ষা
কুরআনে বর্ণিত যুলকারনাইন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন, যিনি পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। কুরআনে তার তিনটি অভিযানের কথা বর্ণিত আছে।
কুরআনে বর্ণিত তার শেষ অভিযানে তিনি দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি স্থানে এসে উপস্থিত হন। সেখানকার অধিবাসীরা তাকে জানায়, দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী গিরিপথ ধরে দুইটি অসভ্য জাতি ইয়াজুজ ও মাজুজের লোকেরা এসে তাদের লুটপাট করে। তারা ইয়াজুজ-মাজুজের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য যুলকারনাইনের সাহায্য চায়। যুলকারনাইন তাদেরকে সাহায্য করার জন্য সম্মত হন।
যুলকারনাইন কখনোই তার ক্ষমতার জন্য গর্বিত ছিলেন না। ইয়াজুজ-মাজুজের আক্রমনের বিরুদ্ধে দুই পাহাড়ের মাঝে তার প্রাচীর তৈরির পর তার বক্তব্য থেকে প্রকাশ পায় আল্লাহর প্রতি তার ভরসা ও আনুগত্য।
“যুলকারনাইন বললেনঃ এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ। যখন আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুতি সত্য।” (সূরা কাহাফ, আয়াত: ৯৮)
শিক্ষাঃ ক্ষমতার উপর পরীক্ষা।
সূরা কাহাফের কতিপয় ফজীলতঃ
আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি সূরা কাহাফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্ত করবে (এবং তা পাঠ করবে) তাকে দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাজতে রাখা হবে”। (সহীহ মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ “যে ব্যক্তি সূরা কাহাফ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন তার জন্য এমন একটি নূর হবে, যা তার অবস্থানের জায়গা থেকে মক্কা পর্যন্ত আলোকিত করে দিবে। আর যে ব্যক্তি উহার শেষ দশটি আয়াত পাঠ করবে, তার জীবদ্দশায় দাজ্জাল বের হলেও সে তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না”। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ২৬৫১) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ
“যে ব্যক্তি জুমআর রাত্রিতে সূরা কাহাফ পাঠ করবে, তার জন্য স্বীয় অবস্থানের জায়গা হতে পবিত্র মক্কা পর্যন্ত একটি নূর হবে”। (দেখুনঃ সহীহ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৭৩৬) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
“যে ব্যক্তি জুমআর দিনে সূরা কাহাফ পাঠ করবে, তার জন্য পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত আলোকময় হবে”। (দেখুনঃ সহীহ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৭৩৬)
সূরার শুরুতে মহান আল্লাহ নিজেই নিজের প্রশংসা করছেন। এ ধরনের প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। প্রথম ও শেষ সর্বাবস্থায় শুধু তাঁরই প্রশংসা করা যায়। তিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কিতাব নাযিল করেছেন সুতরাং তিনি প্রশংসিত; কারণ এর মাধ্যমে তিনি মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছেন। এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কী-ই বা আছে।
তিনি বক্রতা রাখেননি অর্থাৎ এর মধ্যে এমন কোন কথাবার্তা নেই যা বুঝতে পারা যায় না। আবার সত্য ও ন্যায়ের সরল রেখা থেকে বিচুত এমন কথাও নেই যা মেনে নিতে কোন সত্যপন্থী লোক ইতস্তত করতে পারে।
যারা আল্লাহর সন্তান-সন্ততি আছে বলে দাবী করে এদের মধ্যে রয়েছে নাসারা, ইহুদী ও আরব মুশরিকরা। তাছাড়া পাক-ভারতের হিন্দুরাও আল্লাহর জন্য সন্তান-সন্ততি সাব্যস্ত করে থাকে।
অৰ্থাৎ তাদের এ উক্তি যে, অমুক আল্লাহর পুত্র অথবা অমুককে আল্লাহ পুত্র হিসেবে গ্ৰহণ করেছেন, এগুলো তারা এ জন্য বলছে না যে, তাদের আল্লাহর পুত্র হবার বা আল্লাহর কাউকে পুত্র বানিয়ে নেবার ব্যাপারে তারা কিছু জানে। বরং নিছক নিজেদের ভক্তি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কারণে তারা একটি মনগড়া মত দিয়েছে এবং এভাবে তারা যে কত মারাত্মক গোমরাহীর কথা বলছে এবং বিশ্বজাহানের মালিক ও প্ৰভু আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কত বড় বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই। এভাবে তারা নিজেরা যেমন পথভ্রষ্ট হচ্ছে তেমনি ভ্ৰষ্ট করছে তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকেও।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সে সময় যে মানসিক অবস্থার টানাপোড়ন চলছিল এখানে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। তিনি তাদের হিদায়াতের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা আল্লাহ্র আযাবের সম্মুখীন হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তার এ মানসিক অবস্থাকে একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মতো যে আলোর জন্য আগুন জ্বালালো কিন্তু পতংগরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করলো পুড়ে মরার জন্য। সে এদেরকে কোনক্রমে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে। কিন্তু এ পতংগরা তার কোন প্রচেষ্টাকেই ফলবতী করতে দেয় না। আমার অবস্থাও অনুরূপ। আমি তোমাদের হাত ধরে টান দিচ্ছি। কিন্তু তোমরা আগুনে লাফিয়ে পড়ছো।” [বুখারীঃ ৩২৪৪, ৬১১৮ ও মুসলিমঃ ২২৮৪] সূরা আশ শু’আরার ৩ নং আয়াতেও এ ব্যাপারে আলোচনা এসেছে।
অর্থাৎ পৃথিবীর জীবজন্তু, উদ্ভিদ, জড় পদার্থ এবং ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন বস্তুর খনি- এগুলো সবই পৃথিবীর সাজ-সজ্জা ও চাকচিক্য। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়া সুমিষ্ট নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভরা, আল্লাহ এতে তোমাদেরকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে দেখতে চান তোমরা এতে কি ধরনের আচরণ কর। সুতরাং তোমরা দুনিয়ায় মত্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাক এবং মহিলাদের থেকেও বেঁচে থাক। কেননা; বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রথম ফিতনা ছিল মহিলাদের মধ্যে।” [মুসলিম: ২৭৪২]
পৃথিবী পৃষ্ঠে তোমরা এই যেসব সাজ সরঞ্জাম দেখছো এবং যার মন ভুলানো চাকচিক্যে তোমরা মুগ্ধ হয়েছ, এতো নিছক একটি সাময়িক সৌন্দর্য, নিছক তোমাদের পরীক্ষার জন্য এর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এসব কিছু আমি তোমাদের আয়েশ আরামের জন্য সরবরাহ করেছি, তোমরা এ ভুল ধারণা করে বসেছে। এগুলো আয়েশ আরামের জিনিস নয়, বরং পরীক্ষার উপকরণ। যেদিন এ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে সেদিনই ভোগের এসব সরঞ্জাম খতম করে দেয়া হবে এবং তখন এ পৃথিবী একটি লতাগুল্মহীন ধূ ধূ প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
كهف এর অর্থ বিস্তীর্ণ পার্বত্য গুহা। বিস্তীর্ণ না হলে তাকে غار বলা হয়।
رَقِيم (রাকীম) কারো নিকট সেই গ্রামের নাম, যেখান থেকে এই যুবকরা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ বলেছেন, সেই পাহাড়ের নাম, যাতে ঐ গুহা ছিল। অনেকের মতে, رَقِيْمٌ মানে مَرْقُوْمٌ অর্থাৎ, লোহা অথবা সীসার তৈরী তক্তি যাতে গুহার অধিবাসীদের নাম অঙ্কিত ছিল। এটাকে رَقِيم (অঙ্কিত বা লিপিবদ্ধ)এ জন্য বলা হয় যে, এতে নাম লিপিবদ্ধ ছিল। বর্তমান তত্ত্ব-গবেষণা দ্বারা জানা যায় যে, প্রথম কথাটাই বেশী সঠিক। কারণ, যে পাহাড়ে এই গুহা রয়েছে, তার সন্নিকটেই রয়েছে একটি জনপদ, যেটাকে এখন الرقيب (আররাকীব) বলা হয়। বহুকাল অতিবাহিত হওয়ার কারণে الرقيم এর বিকৃত রূপ হয়েছে الرقيب (আররাক্বীব)।
মূলতঃ আসহাবে কাহফ ও আসহাবে রকীম একই দলের দুই নাম, না তারা আলাদা দু’টি দল? এ মতভেদ নিয়েই উপরোক্ত মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। যদিও কোন সহীহ হাদীসে এ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই, কিন্তু ইমাম বুখারী ‘সহীহ’ নামক গ্রন্থে আসহাবে কাহফ ও আসহাবে রকীমের দুটি আলাদা আলাদা শিরোনাম রেখেছেন। ইমাম বুখারীর এ কাজ থেকে বোঝা যায় যে, তার মতে আসহাবে কাহফ ও আসহাবে রকীম পৃথক পৃথক দু’টি দল। হাফেজ ইবনে হাজার ও অধিকাংশ তাফসীরবিদের মতে কুরআনের পূর্বাপর বর্ণনা অনুযায়ী আসহাবে কাহফ ও আসহাবে রকীম একই দল।
এরা হল সেই যুবকদল, যাদেরকে ‘আসহাবে কাহ্ফ’(গুহার অধিবাসী) বলা হয়েছে। এ ধরনের দো’আ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও করতেন এবং উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলতেনঃ اللَّهُمَّ مَا قَضَيْتَ لَنَا مِنْ قَضَاءٍ فَاجْعَلْ عَاقِبَتَهُ رُشْدًا “হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আপনি যা ফয়সালা করেছেন সেগুলোর সুন্দর সমাপ্তি দিন”। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৮১] তারা যখন নিজেদের দ্বীনের রক্ষার্থে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখন এই প্রার্থনা করেছিল। আসহাবে কাহ্ফদের এই ঘটনায় যুবকদের জন্য রয়েছে গুরুতত্ত্বপূর্ণ শিক্ষা। বর্তমানে যুবকদের বেশীর ভাগ সময় নষ্ট হয় অনর্থক কার্যকলাপে তথা আল্লাহর প্রতি তাদের তেমন কোন ভ্রূক্ষেপ থাকে না।
(فَضَرَبْنَا عَلَىٰ آذَانِهِمْ) এর শাব্দিক অর্থ কর্ণকুহর বন্ধ করে দেয়া। অচেতন নিদ্রাকে এই ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। কেননা, নিদ্রায় সর্বপ্রথম চক্ষু বন্ধ হয়, কিন্তু কান সক্রিয় থাকে। আওয়াজ শোনা যায়। অতঃপর যখন নিদ্ৰা পরিপূর্ণ ও প্রবল হয়ে যায়, তখন কানও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। জাগরণের সময় সর্বপ্রথম কান সক্রিয় হয়। আওয়াজের কারণে নিদ্রিত ব্যক্তি সচকিত হয়, অতঃপর জাগ্রত হয়।
এই দু’টি দল বলতে তারা, যারা মতবিরোধ করেছিল। এরা হয়তো সেই যুগেরই মানুষ ছিল, যাদের মধ্যে এদের ব্যাপারে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। অথবা নবী (সাঃ)-এর যুগের মু’মিন ও কাফেররা। আবার কেউ বলেছেন, এরা ছিল গুহারই অধিবাসী। তাদের মধ্যে দু’টি দল হয়ে গিয়েছিল। একদল বলল, আমরা এত দিন এখানে ঘুমিয়ে ছিলাম। অন্য দল এ কথা অস্বীকার করে প্রথম দলের চেয়ে কিছু কম-বেশী সময়-কাল বলল।
আসহাবে কাহফের স্থান ও কাল নির্ণয়ে বিভিন্ন মত এসেছে। এগুলোর কোনটি যে সঠিক সে ব্যাপারে সঠিক কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। আলেমগণ এ ব্যাপারে দুটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাদের একদলের মত হলো, আমাদেরকে শুধু এ ঘটনার শুদ্ধ হওয়া ও তা থেকে শিক্ষা নেয়ার উপরই প্রচেষ্টা চালানো উচিত। তাদের স্থান ও কাল নির্ধারনে ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য একদল মুফাসসির ও ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত পেশ করার মাধ্যমে কাহিনীটি বোঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন।
তাদের অধিকাংশের মতে, আসহাবে কাহফের ঘটনাটি ঘটে আফসোস নগরীতে। হাফেয। ইবন কাসীর রাহেমাহুল্লাহ তার তাফসীরে এ সাতজন যুবকের কালকে ঈসা আলাইহিস সালামের পূর্বেকার ঘটনা বলে মত দিয়েছেন। ইয়াহুদীগণ কর্তৃক এ ঘটনাটিকে বেশী প্রাধান্য দেয়া এবং মক্কার মুশরিকদেরকে এ বিষয়টি নিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করতে শিখিয়ে দেয়াকে তিনি তার মতের সপক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করেন।
কিন্তু অধিকাংশ মুফাসসির ও ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাটিকে ঈসা আলাইহিস সালামের পরবর্তী ঘটনা বলে বর্ণনা করে থাকেন। তাদের মতে, ঈসা আলাইহিস সালামের পর যখন তার দাওয়াত রোম সামাজ্যে পৌঁছতে শুরু করে তখন এ শহরের কয়েকজন যুবকও শির্ক থেকে তাওবা করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে তাদের যে বর্ণনা এসেছে তা সংক্ষেপ করলে নিম্নরূপ দাঁড়ায়ঃ তারা ছিলেন সাতজন যুবক। তাদের ধর্মান্তরের কথা শুনে তৎকালীন রাজা তাদেরকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান।
তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের ধর্ম কি? তারা জানতেন, এ রাজা ঈসার অনুসারীদের রক্তের পিপাসু। কিন্তু তারা কোন প্রকার শংকা না করে পরিষ্কার বলে দেন, আমাদের রব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদকে আমরা ডাকি না। যদি আমরা এমনটি করি তাহলে অনেক বড় গুনাহ করবো। রাজা প্রথমে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তোমাদের মুখ বন্ধ করো, নয়তো আমি এখনই তোমাদের হত্যা করার ব্যবস্থা করবো।
তারপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললেন, তোমরা এখনো শিশু। তাই তোমাদের তিনদিন সময় দিলাম। ইতিমধ্যে যদি তোমরা নিজেদের মত বদলে ফেলো এবং জাতির ধর্মের দিকে ফিরে আসো তাহলে তো ভাল, নয়তো তোমাদের শিরশ্ছেদ করা হবে। এ তিন দিন অবকাশের সুযোগে এ সাতজন যুবক শহর ত্যাগ করেন। তারা কোন গুহায় লুকাবার জন্য পাহাড়ের পথ ধরেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথে চলতে থাকে। তারা কুকুরটাকে তাদের পিছু নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেন।
কিন্তু সে কিছুতেই তাদের সংগ ত্যাগ করতে রাযী হয়নি। শেষে একটি বড় গভীর বিস্তৃত গুহাকে ভাল আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে তারা তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। কুকুরটি গুহার মুখে বসে পড়ে। দারুন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকার কারণে তারা সবাই সংগে সংগেই ঘুমিয়ে পড়েন। কয়েকশত বছর পর তারা জেগে উঠেন। তখন ছিল অন্য রাজার শাসনামল। রোম সাম্রাজ্য তখন নাসারা ধর্ম গ্ৰহণ করেছিল এবং আফসোস শহরের লোকেরাও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেছিল।
এটা ছিল এমন এক সময় যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে মৃত্যু পরের জীবন এবং কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে জমায়েত ও হিসেব নিকেশ হওয়া সম্পর্কে প্ৰচণ্ড মতবিরোধ চলছিল। আখেরাত অস্বীকারের বীজ লোকদের মন থেকে কিভাবে নির্মূল করা যায় এ ব্যাপারটা নিয়ে কাইজার নিজে বেশ চিন্তিত ছিলেন। একদিন তিনি আল্লাহর কাছে দো’আ করেন যেন তিনি এমন কোন নির্দশন দেখিয়ে দেন যার মাধ্যমে লোকেরা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ঘটনাক্রমে ঠিক এ সময়েই এ যুবকরা ঘুম থেকে জেগে উঠেন। জেগে উঠেই তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?
কেউ বলেন একদিন, কেউ বলেন দিনের কিছু অংশ। তারপর আবার একথা বলে সবাই নীরব হয়ে যান যে এ ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন। এরপর তারা নিজেদের একজন সহযোগীকে রূপার কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে খাবার আনার জন্য শহরে পাঠান। তারা ভয় করছিলেন, লোকেরা আমাদের ঠিকানা জানতে পারলে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে এবং মূর্তি পূজা করার জন্য আমাদের বাধ্য করবে। কিন্তু লোকটি শহরে পৌঁছে সবকিছু বদলে গেছে দেখে অবাক হয়ে যান। একটি দোকানে গিয়ে তিনি কিছু রুটি কিনেন এবং দোকানদারকে একটি মুদ্রা দেন।
এ মুদ্রার গায়ে অনেক পুরাতন দিনের সম্রাটের ছবি ছাপানো ছিল। দোকানদার এ মুদ্রা দেখে অবাক হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, এ মুদ্রা কোথায় পেলে? লোকটি বলে, এ আমার নিজের টাকা, অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসিনি। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। লোকদের ভীড় জমে উঠে। এমন কি শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নগর কোতোয়ালের কাছে পৌছে যায়। কোতোয়াল বলেন, এ গুপ্ত ধন যেখান থেকে এনেছো সেই জায়গাটা কোথায় আমাকে বলে। সে বলেন, কিসের গুপ্তধন? এ আমার নিজের টাকা। কোন গুপ্তধনের কথা আমার জানা নেই।
কোতোয়াল বলেন, তোমার একথা মেনে নেয়া যায় না। কারণ তুমি যে মুদ্রা এনেছো এতো কয়েক শো বছরের পুরনো। তুমি তো সবেমাত্র যুবক, আমাদের বুড়োরাও এ মুদ্রা দেখেনি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। লোকটি যখন শোনেন অত্যাচারী যালেম শাসক মারা গেছে বহুযুগ আগে তখন তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন কথাই বলতে পারেন না। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, এ তো মাত্ৰ কালই আমি এবং আমার ছয়জন সাথী এ শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম এবং যালেম বাদশার যুলুম থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। লোকটির একথা শুনে কোতোয়ালও অবাক হয়ে যান।
তিনি তাকে নিয়ে যেখানে তার কথা মতো তারা লুকিয়ে আছেন সেই গুহার দিকে চলেন। বিপুল সংখ্যক জনতাও তাদের সাথী হয়ে যায়। তারা যে যথার্থই অনেক আগের সম্রাটের আমলের লোক সেখানে পৌঁছে। এ ব্যাপারটি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায়। এ ঘটনার খবর তৎকালীন সম্রাটের কাছেও পাঠানো হয়। তিনি নিজে এসে তাদের সাথে দেখা করেন। তারপর হঠাৎ তারা সাতজন গুহার মধ্যে গিয়ে সটান শুয়ে পড়েন এবং তাদের মৃত্যু ঘটে। এ সুস্পষ্ট নির্দশন দেখে লোকেরা যথার্থই মৃত্যুর পরে জীবন আছে বলে বিশ্বাস করে। এ ঘটনার পর সম্রাটের নির্দেশে গুহায় একটি ইবাদাতখানা নির্মাণ করা হয়।
যখন তারা খাঁটি মনে ঈমান আনলো তখন আল্লাহ তাদের ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যমে সঠিকপথে চলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিলেন এবং তাদের ন্যায় ও সত্যের উপর অবিচল থাকার সুযোগ দিলেন। তারা নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে কিন্তু বাতিলের কাছে মাথা নত করবে না। এ আয়াত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের একটি সুস্পষ্ট দলীল যে, ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। অনুরূপ দলীল সূরা মুহাম্মদ এর ১৭, সূরা আত-তাওবার ১২৪ এবং সূরা আল-ফাতিহ এর ৪ নং আয়াতেও এসেছে।
হিজরত করার কারণে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ধাক্কা যেহেতু তাদের উপর আসছে, তাই আল্লাহ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করে দিলেন। যাতে তারা তাদের জীবনের বিপদ-আপদকে খুশী মনে বরণ করে নিতে পারে। অনুরূপ হক বলার দায়িত্বকেও যেন সাহস ও উৎসাহের সাথে পালন করতে পারে।
এই দাঁড়ানো অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট রাজার দরবারে ছিল, তারা রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তাওহীদের ওয়ায করেছিল। কেউ কেউ বলেন, শহর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আপোসে একে অপরকে তাওহীদের সেই কথা শুনাতে লাগলেন, যা এক এক করে প্রত্যেকের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল এবং এইভাবে তারা আপোসে একত্রিত হয়ে গেল।
شَطَطًا অর্থ, মিথ্যা অথবা সীমালঙ্ঘন করা।
হিজরত করার কারণে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ধাক্কা যেহেতু তাদের উপর আসছে, তাই আল্লাহ তাদের অন্তরকে সুদৃঢ় করে দিলেন। যাতে তারা তাদের জীবনের বিপদ-আপদকে খুশী মনে বরণ করে নিতে পারে। অনুরূপ হক বলার দায়িত্বকেও যেন সাহস ও উৎসাহের সাথে পালন করতে পারে।
এই দাঁড়ানো অধিকাংশ মুফাসসিরের নিকট রাজার দরবারে ছিল, তারা রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তাওহীদের ওয়ায করেছিল। কেউ কেউ বলেন, শহর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আপোসে একে অপরকে তাওহীদের সেই কথা শুনাতে লাগলেন, যা এক এক করে প্রত্যেকের অন্তরে ভরে দেওয়া হয়েছিল এবং এইভাবে তারা আপোসে একত্রিত হয়ে গেল।
شَطَطًا অর্থ, মিথ্যা অথবা সীমালঙ্ঘন করা।
এ আয়াত থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, যদি কোথাও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, সেখানে অবস্থান করলে তাওহীদ ও ঈমান বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তখন সেখান থেকে হিজরত করতে হবে। যেখানে গেলে দ্বীন নিয়ে থাকতে পারবে সেখানে তাকে যেতে হবে। আর এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘অচিরেই এমন এক সময় আসবে যখন একজন ঈমানদারের সবচেয়ে বড় সম্পদ হবে কিছু ছাগল পাল যেগুলো নিয়ে সে পাহাড়ের চুড়া এবং বৃষ্টিস্নাত ভূমির পিছনে ছুটিতে থাকবে। তার মূল উদ্দেশ্য হবে ফিতনা থেকে তার নিজ দ্বীনকে বাঁচিয়ে রাখা।” [বুখারীঃ ১৯, ৩৩০০, সুনান আবু দাউদঃ ৪২৩৭, মুসনাদে আহমাদঃ ৩/৪৩] [ইবন কাসীর]
তারা যখন তাদের দ্বীন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল মহান আল্লাহ তখন তাদের জন্য তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে সহজ সরল করে দিলেন। তারা পালিয়ে গুহাতে আশ্রয় নিল, তাদের জাতি তাদেরকে খুজে বের করতে অসমর্থ হলো এমনকি তৎকালীন বাদশাহও তাদের ব্যাপারে খোঁজাখুঁজি করে শেষে অপারগ হয়ে গেলেন। আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকরকেও এমনি এক সঙ্কটময় মুহুর্তে রক্ষা করেছিলেন। তারা উভয়ে সাওর গিরি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কুরাইশরা তাদের পিছু নিয়ে গর্তের মুখে প্রায় চলে আসছিল। কিন্তু তারা তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারল না। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটু ভীত হয়ে বলেই ফেললেন, রাসূল! যদি তারা তাদের পায়ের নীচে তাকিয়ে দেখে তবে আমাদের দেখতে পাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রশান্ত চিত্তে উত্তর করলেনঃ আবু বকর! যে দু’জনের জন্য তৃতীয় জন আল্লাহ রয়েছেন তাদের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা? [বুখারী: ৩৬৫৩, মুসলিম: ২৩৮১]
মহান আল্লাহ গুহাবস্থানের এ ঘটনাটিকে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে বলেছেনঃ “যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তো তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাঁকে বহিষ্কার করেছিল এবং তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল; তিনি তখন তাঁর সংগীকে বলেছিলেন, “বিষন্ন হয়ে না, আল্লাহ তো আমাদের সাথে আছেন।” তারপর আল্লাহ তাঁর উপর তাঁর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং তাকে শক্তিশালী করেন এমন এক সৈন্যবাহিনী দ্বারা যা তোমরা দেখনি এবং তিনি কাফিরদের কথা হেয় করেন। আল্লাহর কথাই সর্বোপরি এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহঃ ৪০] সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুহাবস্থানের ঘটনা আসহাবে কাহফের গুহাবস্থানের ঘটনা থেকে অধিক মর্যাদা, গুরুত্বপূর্ণ ও আশ্চর্যজনক।
আয়াতের অর্থ বর্ণনায় দু’টি মত রয়েছে। এক. তারা গুহার এক কোনে এমনভাবে আছে যে, সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না। স্বাভাবিক আড়াল তাদেরকে সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করছে। কারণ, তাদের গুহার মুখ ছিল উত্তর দিকে। এ কারণে সূর্যের আলো কোন মওসুমেই গুহার মধ্যে পৌঁছতো না এবং বাহির থেকে কোন পথ অতিক্রমকারী দেখতে পেতো না গুহার মধ্যে কে আছে।
দুই. তারা একটি প্রশস্ত চত্বরে অবস্থান করা সত্বেও দিনের বেলার আলো সূর্যের উদয় বা অস্ত কোন অবস্থায়ই তাদের কাছে পৌছে না। কেননা, মহান আল্লাহ তাদের সম্মনার্থে এ অলৌকিক ব্যবস্থা করেছেন। প্রশস্ত স্থানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে কোন বাধা না থাকলেও তিনি তার স্পেশাল ব্যবস্থাপনায় তাদেরকে সূর্যের আলোর তাপ থেকে রক্ষা করেছেন। এ অর্থের সপক্ষে প্রমাণ হলো এর পরে বর্ণিত মহান আল্লাহর বাণীঃ “এটা তো আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম”। যদি স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা হতো তবে আল্লাহর নিদর্শন বলার প্রয়োজন ছিল না। ইবনে আব্বাস বলেন, সূর্যের আলো যদি তাদের গায়ে লাগত। তবে তাদের কাপড় ও শরীর পুড়ে যেতে পারত।
ফুটনোট
* সূরা কাহাফে চারটি ঘটনার বর্ণনা আছে। এই চারটি ঘটনার সাথে জড়িত আছে চার ধরণের ফিতনা এবং তা থেকে মুক্তি পাবার উপায়।
ঘটনাগুলো হলো –
১) আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীদের ঘটনা
২) দুই বাগানের মালিক ও তার বন্ধুর ঘটনা,
৩) মুসা (আ) ও খিজির (আ)-এর ঘটনা, এবং
৪) যুলকারনাইন এর ঘটনা,
আর, ফিতনাগুলো হলো –
১) সমাজের ফিতনা, যেখানে ধর্ম ও বিশ্বাস টিকিয়ে রাখা যায় না।
২) সম্পদের ফিতনা, যা দিয়ে মানুষ নিজেকে সর্বাধিকারী মনে করে।
৩) জ্ঞানের ফিতনা, যা দিয়ে মানুষ অহংকার করে। এবং
৪) ক্ষমতার ফিতনা, যা দিয়ে মানুষ অন্যের উপর জুলুম করে।
* তাওহীদকে মেনে নেওয়া মানুষের ফিতরাতি তথা সৃষ্টিগত স্বভাব। অর্থাৎ কোন মানুষকে যদি তার স্বভাজাত ধর্মের উপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাইরের কোন গোমরাহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত না করে, তাহলে সে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিবে, তারই এবাদত করবে এবং তাঁর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। যেমনটি হয়েছেলি ঘটনায় বর্ণিত যুবকদের ক্ষেত্রে।
* যেসব তরুণদের কথা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, তাদের কেউ নবী বা রাসূল ছিলেন না। তারা সবাই ছিলেন সমাজ পরিবর্তনকারী বা সমাজকর্মী। এ কারণে তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন – “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন।”
* এখানে কোনো বয়স্ক যুবক, পুরুষ বা বৃদ্ধ ব্যক্তির কথা বলা হয়নি। বরং আয়াতের ভাষ্যমতে বোঝা যায় যে, এরা হলো অবিবাহিত কিছু তরুণ, এবং যাদের বয়স ছিল কম।
* এখানে একক কোনো ব্যক্তির কথা বর্ণনা করা হয়নি। বরং সঙ্ঘবদ্ধ কিছু তরুণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
* পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় যুবকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
* প্রয়োজনে সত্য গোপন করা জায়েয আছে। কিন্তু তা সকল সময়ের জন্য নয়।
* সাহসের সাথে তাওহীদের বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করা জরুরী।
* নিজ দেশে দ্বীন পালন করতে গিয়ে ফিতনার ভয় থাকলে দ্বীন নিয়ে পলায়ন করা আবশ্যক।
* আসহাবে কাহাফের ঘটনা আল্লাহর বিশেষ একটি বড় নিদর্শন। তবে তার চেয়েও বড় নিদর্শন হচ্ছে, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্যের সৃষ্টি এবং দিবা রাত্রির আগমণ ও প্রস্থান।
* বিপদাপদে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তাঁর দয়া কামনা করা জরুরী।
* আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের খেদমতের জন্য বড় বড় মাখলুককে বাধ্য করেন।
* একজন দাঈ প্রয়োজনে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। বিশেষ করে যখন তাঁর পিছনে শত্রুরা ষড়যন্ত্র শুরু করে।
* সুখে-দুঃখে হালাল রুজী অনুসন্ধান করা জরুরী।