Notes 35 Sura Baqarah 267 to 273

কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২

প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ৩৫

সূরা বাকারাহ ২৬৭-২৭৩

শানে নুযূল:
বারা বিন আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: এ আয়াতটি আমাদের আনসারদের ব্যাপারে নাযিল হয়। আমরা ছিলাম খেজুরের মালিক। যার যেমন সাধ্য ছিল সে অনুযায়ী কম-বেশি দান করার জন্য নিয়ে আসত। কিছু মানুষ ছিল যাদের কল্যাণমূলক কাজে কোন উৎসাহ ছিল না। তাই তারা খারাপ ও নিম্নমানের খেজুর নিয়ে এসে মাসজিদে নাববীর খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে দিত। ফলে
(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا….. مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ)
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি তার মধ্য হতে পবিত্র জিনিস দান কর’নাযিল হয়। (সহীহ, তিরমিযী হা: ২৯৮৭)

দান-সদাকাহ আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হওয়ার জন্য যেমন শর্ত হল দান-সদাকাহ করার পর খোঁটা বা কষ্ট দেয়া যাবে না, তেমনি আরো দু’টি শর্ত রয়েছে: (১) হালাল ও পবিত্র উপার্জন হতে দান করতে হবে। হালাল উপার্জন ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে হতে পারে অথবা কায়িম শ্রম ও চাকুরীর মাধ্যমেও হতে পারে। সেদিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘তোমরা যা উপার্জন করেছ।’আবার জমি থেকে উৎপাদিত পবিত্র ফসল হতেও দান করা যাবে। সেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন ‘আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি তার মধ্য হতে’। হারাম পন্থায় উপার্জন করে দান-সদাকাহ করলে, হজ্জ করলে কোন উপকারে আসবে না।

(২) যে দান-সদাকাহ করবে তাকেও সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হতে হবে। কোন খারাপ নিয়তে কিংবা নাম-যশ অর্জনের উদ্দেশ্যে দান-সদাকাহ করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবুল হবে না। এ ব্যক্তি ঐ অজ্ঞ কৃষক সদৃশ, যে বীজকে অনুর্বর মাটিতে বপন করে, ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়।

(أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْأَرْضِ)
‘আমি জমিন থেকে যা উৎপন্ন করি’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা জমিন থেকে যা উৎপন্ন করেন যেমন: শস্য, গুপ্তধন ইত্যাদি। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা সেচ ব্যতীত উর্বরতার ফলে উৎপন্ন ফসলের ওপর উশর (দশ ভাগের একভাগ) ওয়াজিব। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর অর্ধ উশর (বিশ ভাগের এক ভাগ) ওয়াজিব। (সহীহ বুখারী হা: ১৪৮৩)

 

الْخَبِيْثُ বা ‘মন্দ জিনিস’এর দু’টি অর্থ হতে পারে:
(১) এমন জিনিস যা অবৈধ পথে উপার্জন করা হয়েছে। তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:إِنَّ اللّٰهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া গ্রহণ করেন না।

(২) খারাপ ও অতি নিম্নমানের জিনিস যা তাকে দেয়া হলে সে নিজেও নেবে না। এমন নষ্ট খারাপ জিনিস যা নিজে পছন্দ করে না তা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় ব্যয় করলে আল্লাহ তা‘আলাও গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّي تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ﹽ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللّٰهَ بِهِ عَلِيمٌ)
“তোমরা নেকী পাবে না যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় জিনিস আল্লাহর পথে খরচ কর। আর তোমরা যা কিছুই দান কর আল্লাহ তা জানেন।”(সূরা আলি-ইমরান ৩:৯২)

এসব খারাপ জিনিস তোমরাও তো চক্ষু বন্ধ না করে গ্রহণ করতে চাও না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّي يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ
তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য যা পছন্দ করো তা অপর ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করো। (সহীহ বুখারী হা: ১৩)

আল্লাহ তা‘আলা এসব দান-সদাকাহ থেকে অনেক বড়, অমুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলার এসব নির্দেশ শুধু পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَنْ يَنَالَ اللّٰهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَي مِنْكُمْ)
“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্ওয়া।”(সূরা হাজ্জ ২২:৩৭)
পরবর্তী আয়াতে শয়তানের কুমন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। সৎ পথে ব্যয় করতে চাইলে শয়তান নিঃস্ব ও দরিদ্র হওয়ার ভয় দেখায়। পক্ষান্তরে অন্যায় অশ্লীল বেহায়াপনাপূর্ণ কাজে উৎসাহ দেয় এবং এমনভাবে চাকচিক্য করে তুলে ধরে যে, মানুষ তাতে ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

যখন কারো মনে এ ধারণা জন্মে যে, দান-সদকা করলে ফকীর হয়ে যাবে, বিশেষতঃ আল্লাহ তা’আলার তাকীদ শুনেও স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করার সাহস না হয় এবং আল্লাহর ওয়াদা থেকে মুখ ফিরিয়ে শয়তানী ওয়াদার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন বুঝে নেয়া উচিত যে, এ প্ররোচনা শয়তানের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে যদি মনে ধারণা জন্মে যে, দান-সদকা করলে গোনাহ মাফ হবে এবং ধন-সম্পত্তিও বৃদ্ধি পাবে ও বরকত হবে, তখন মনে করতে হবে, এ বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে। এমতাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহর ভাণ্ডারে কোন কিছুর অভাব নেই। তিনি সবার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং নিয়্যত ও কর্ম সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত।

প্রথম আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, অর্থাৎ হজ, জিহাদ কিংবা ফকীর, মিসকীন, বিধবা ও ইয়াতীমদের জন্য কিংবা সাহায্যের নিয়্যতে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত হল যেমন, কেউ গমের একটি দানা সরস জমিতে বপন করল। এ দানা থেকে একটি চারা গাছ উৎপন্ন হল, যাতে গমের সাতটি শীষ এবং প্রত্যেকটি শীষে একশ’ করে দানা থাকে। অতএব, এর ফল দাঁড়ালো এই যে, একটি দানা থেকে সাতশ দানা অর্জিত হয়ে গেল। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর পথে ব্যয় করার সওয়াব এক থেকে শুরু করে সাতশ পর্যন্ত পৌছে। এক পয়সা ব্যয় করলে সাতশ’ পয়সার সওয়াব অর্জিত হতে পারে। সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহে বর্ণিত আছে, একটি সৎকর্মের সওয়াব দশগুণ পাওয়া যায় এবং তা সাতশ গুণে পৌছে। [দেখুন, বুখারী ৪১, মুসলিম: ১২৮]

আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এ বিষয়বস্তুটি সংক্ষিপ্ত ও পরিস্কার ভাষায় বর্ণনা করার পরিবর্তে গম-বীজের দৃষ্টান্ত আকারে বর্ণনা করেছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কৃষক গমের এক দানা থেকে সাতশ দানা তখনই পেতে পারে, যখন দানাটি হবে উৎকৃষ্ট। কৃষকও কৃষি বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল হবে এবং জমিও হবে সরস। কেননা, এ তিনটি বিষয়ের যেকোন একটি বিষয়ে অভাব হলেও হয় দানা বেকার হয়ে যাবে অর্থাৎ একটি দানাও উৎপন্ন হবে না, কিংবা এক দানা থেকে সাতশ দানার মত ফলনশীল হবে না। এমনিভাবে সাধারণ সৎকর্ম এবং বিশেষ করে আল্লাহর পথে কৃত ব্যয় গ্রহণীয় ও অধিক সওয়াব পাওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছেঃ

পবিত্র ও হালাল ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা। হাদীসে আছে, আল্লাহ তা’আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করেন না। [মুসলিম: ১০১৫]

যে ব্যয় করবে তাকেও সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত ও সৎ হতে হবে। কোন খারাপ নিয়্যতে কিংবা নাম-জশ অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ব্যয় করে, সে ঐ অজ্ঞ কৃষকের মত, যে বীজকে অনুর্বর মাটিতে বপন করে, ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়।

যার জন্য ব্যয় করবে, তাকেও সদকার যোগ্য হতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তির জন্য ব্যয় করলে সদকা ব্যর্থ হবে। এভাবে বর্ণিত দৃষ্টান্ত দ্বারা আল্লাহর পথে ব্যয় করার ফযীলতও জানা গেল এবং সাথে সাথে তিনটি শর্তও জানা গেল যে, হালাল ধন-সম্পদ ব্যয় করতে হবে, ব্যয় করার রীতিও সুন্নাত অনুযায়ী হতে হবে এবং যোগ্য ব্যক্তির জন্য ব্যয় করতে হবে। শুধু পকেট থেকে বের করে দিয়ে দিলেই এ ফযীলত অর্জিত হবে না।

‘হেকমত’ শব্দটি কুরআনুল কারীমে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্যেক জায়গায় এর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো প্রায় কাছাকাছি উক্তি। হেকমতের আসল অর্থ প্রত্যেক বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করা। এর পূর্ণত্ব শুধুমাত্র নবুওয়াতের মাধ্যমেই সাধিত হতে পারে। তাই এখানে হেকমত বলতে নবুওয়াতকে বোঝানো হয়েছে। রাগেব ইস্পাহানী বলেনঃ হেকমত শব্দটি আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা হলে এর অর্থ হবে সমগ্র বিষয়াদির পূর্ণ জ্ঞান এবং নিখুঁত আবিস্কার। অন্যের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হলে এর অর্থ হয় সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তদানুযায়ী কর্ম। এ অর্থটিই বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। কোথাও এর অর্থ নেয়া হয়েছে কুরআন, কোথাও হাদীস, কোথাও বিশুদ্ধ জ্ঞান, কোথাও সৎকর্ম, কোথাও সত্যকথা, কোথাও সুস্থ বুদ্ধি, কোথাও দ্বীনের বোধ, কোথাও মতামতের নির্ভুলতা এবং কোথাও আল্লাহর ভয়। কেননা, আল্লাহর ভয়ই প্রকৃত হেকমত। আয়াতে হেকমতের ব্যাখ্যা সাহাবী ও তাবে-তাবেয়ীগণ কর্তৃক হাদীস ও সুন্নাহ বলে বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, আলোচ্য আয়াতে উপরোল্লেখিত সবগুলো অর্থই বোঝানো হয়েছে।

যা কিছু তোমরা ব্যয় কর’ বলতে সর্বপ্রকার ব্যয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে; যে ব্যয়ে সব শর্তের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং যে ব্যয়ে সবগুলোর কিংবা কতকগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়নি। উদাহরণতঃ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়নি বরং গোনাহর কাজে ব্যয় করা হয়েছে, কিংবা লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করা হয়েছে, অথবা ব্যয় করে অনুগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে কিংবা হালাল ও উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করা হয়নি ইত্যাদি, সর্বপ্রকার ব্যয়ই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।

‘মানত’ শব্দের ব্যাপকতায় সর্বপ্রকার মানতই এসে গেছে। মানত বলতে বুঝায় কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন কাজ করার শর্ত করা। যেমন, যদি আমার সন্তান হয় তাহলে আমি হজ করব বা যদি আমার ব্যবসায় সাফল্য আসে তবে আমি এত টাকা দান করব ইত্যাদি। মূলতঃ মানত পূরণ করা ইবাদাত। কিন্তু মানত করা ইবাদাত নয়। মানত করার ব্যাপারে শরীআত কাউকে উৎসাহ দেয়নি। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানত কারো জন্য ভাল কিছু নিয়ে আসে না বরং মানত কৃপণের সম্পদ থেকে কিছু বের করে। [বুখারীঃ ৬৬০৮, ৬৬৯২ ৬৬৯৩]

তাই মানত করার চেয়ে যে ইবাদাতের মানত করার ইচ্ছা করেছে, মানত না করে সে ইবাদাত পালন করে তার অসীলায় দোআ করাই শরীআত নির্দেশিত সঠিক পন্থা। এজন্য শরীআতে মানত করা থেকে নিষেধ এসেছে। কিন্তু যদি কেউ মানত করে, তারপর যদি কাজটা সৎকাজ হয় তবে তা পূরণ করা ওয়াজিব। আর যদি অসৎকাজ হয় তাহলে তা পূরণ করা যাবে না। যেমন, কেউ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হজ করার মানত করলে তাকে হজ করে মানত পূরণ করতে হবে। কিন্তু যদি কেউ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মাযারে বা পীরকে কিছু দেয়ার মানত করলে তা পূরণ করা জায়েয হবে না। কেননা, তা শির্ক।

দান-খয়রাতের পথে একটি বড় বাধা হলো, অধিকাংশ দাতা এটা চান যে, দানের জন্য তার প্রশংসা করা হোক। তাই, এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তোমার ভালো কাজের দিকে কেউ লক্ষ্য না করুক কিংবা কেউ কৃতজ্ঞতা না জানাক, কিন্তু আমি আল্লাহ তো তোমার ভাল কাজের সাক্ষী রইলাম এবং আমার কাছে তোমার কাজ লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড হয়ে রইল। তবে কি তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করছ না? যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে থাকো তবে কেন মানুষের কাছে প্রতিদানের আশা করছ? তাই মানুষের জানা উচিত, আল্লাহ তাদের সব কাজই দেখছেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই হলো সৎকাজের মূল লক্ষ্য। কোরআনের ভাষায় দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি উদাসীনতা ‌এক ধরনের জুলুম বা অন্যায়। জালেম লোকেরা বিচার দিবসে সব ধরনের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে। দান করার ক্ষেত্রে যাকাতের মত ফরজ বা অবশ্য পালনীয় দান প্রকাশ্যে করা ভাল, কিন্তু মুস্তাহাব বা ইচ্ছাধীন দান গোপনে করা ভাল। সম্ভবত: এর যুক্তি হলো ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কাজ করা সবারই দায়িত্ব এবং এতে সাধারণত: লোক দেখানোর প্রবণতা থাকে না এবং অন্যরা ফরজ আদায়ের ব্যাপারে সচেতন হয়।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : আল্লাহ আমাদের দানের খবর রাখেন। তাই সবচেয়ে ভালো সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করতে হবে এবং দানের উদ্দেশ্য হতে হবে সবচেয়ে মহৎ আর সবচেয়ে মহৎ উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

দ্বিতীয়ত : দান করতে হবে কখনো প্রকাশ্যে এবং কখনো গোপনে। প্রকাশ্য-দানে অন্যরা দান করতে উৎসাহী হয়। আর গোপনে দানের মাধ্যমে অহংকার ও নিজেকে জাহির করা থেকে দূরে থাকা যায়।

তৃতীয়ত : দান-খয়রাত হলো গোনাহ মাফ বা ক্ষমা লাভের একটি মাধ্যম। তওবা ও ক্ষমা লাভের জন্য অনেক সময় দান খয়রাত করা উচিত যাতে আল্লাহ আমাদের গোনাহ বা পাপ ক্ষমা করে দেন।

এরপর ২৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

বিভিন্ন তাফসীরের বর্ণনায় দেখা যায়, মুসলমানরা দরিদ্র মুশরিকদের দান করার ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। যখন তাঁরা রাসুল (স.)- কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করল তখন এ আয়াত নাজেল হয়। এ আয়াতে বলা হয়েছে, জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। তাই প্রকৃত মুসলমানের সাহায্য পাওয়ার জন্য মুসলমান হওয়ার সার্টিফিকেট দেখাতে হয় না। আল্লাহ যেমন এ পৃথিবীতে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবাইকে জীবিকা ও অন্যান্য অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন, তেমনি কোন প্রকৃত মুসলমান অভাবী ও দরিদ্রকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কে মুসলমান ও কে অমুসলমান তা দেখেন না। কারণ, সব মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি বলে সাহায্য পাবার অধিকার রাখে। আর ইসলামের শত্রু নয় এমন দরিদ্র অমুসলিমদের সাহায্য করলেও বিচার দিবসে এর পূর্ণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। ইসলাম মানব প্রেমের ধর্ম ও মানব দরদী ধর্ম।

এ থেকে সেই মুহাজিরদের বুঝানো হয়েছে যাঁরা মক্কা ত্যাগ করে আসেন এবং আল্লাহর পথে এসে প্রত্যেক জিনিস থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সব কিছুই তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারী ছাত্র-ছাত্রী এবং আলেমরাও এরই আওতায় পড়তে পারে।

অর্থাৎ, ঈমানদারদের গুণ হল, অভাব-অনটন সত্ত্বেও তারা চাওয়া ও ভিক্ষা করা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে এবং নাছোড় বান্দা হয়ে চাওয়া থেকে বিরত থাকে। কেউ কেউ إلحاف এর অর্থ করেছেন, মোটেই না চাওয়া। কেননা, তাদের প্রথম গুণ বলা হয়েছে যে, তারা যাচ্ঞা করে না। (ফাতহুল ক্বাদীর) আর কেউ কেউ বলেছেন, তারা চাওয়াতে বারবার আবেদন ও কাকুতি-মিনতি করে না এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস লোকের কাছে প্রার্থনা করে না। কারণ, إلحاف হল, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও (স্বভাবগত কারণে) মানুষের কাছে চাওয়া। এই অর্থের সমর্থন সেই হাদীসসমূহ দ্বারাও হয়ে যায় যাতে বলা হয়েছে, ‘‘মিসকীন তো সে নয়, যে একটি-দু’টি খেজুরের জন্য অথবা এক-দু’ লুকমা খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়ে চেয়ে বেড়ায়, বরং আসল মিসকীন তো সেই, যে (অভাব সত্ত্বেও) চাওয়া থেকে বেঁচে থাকে।’’ অতঃপর নবী করীম (সাঃ) প্রমাণস্বরূপ

{لاَ يَسْئَلُوْنَ النَّاسَ إلْحَافًا} আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী ১৪৭৬নং) এই জন্য পেশাদার ভিক্ষুকের পরিবর্তে মুহাজির, দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারী ছাত্র-ছাত্রী, উলামা এবং চাইতে পারে না অথবা চাইতে লজ্জাবোধ করে এমন গুপ্ত অভাবীদের খোঁজ করে তাদের সহযোগিতা করা উচিত। কারণ, অন্যের সামনে হাতপাতা মানুষের আত্মসম্মান পরিপন্থী ও মর্যাদাহানিকর কর্ম। তাছাড়া হাদীসে এসেছে যে, যার কাছে তার প্রয়োজনের যথেষ্ট সামগ্রী থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে ভিক্ষা চায়, কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল ক্ষত-বিক্ষত হবে। (সুনানে আরবাআহ) আর বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে যে, ‘‘যে ব্যক্তি সব সময় মানুষের কাছে চায়, কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডলে গোশত থাকবে না।’’ (বুখারী ১৪৭৫, মুসলিম ১০৪০নং)

ফুটনোট 

২৬৭  আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : দান খয়রাতের ক্ষেত্রেও গরীবদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা উচিত। মূল্যহীন ও আজে বাজে জিনিস দান করার অর্থ হলো অন্যদের অসম্মান করা।

দ্বিতীয়ত : দানের উদ্দেশ্য হলো কৃপণতা থেকে মুক্তি পাওয়া, অপ্রয়োজনীয় ও তুচ্ছ জিনিস থেকে পরিত্রাণ পাওয়া নয়।

তৃতীয়ত : মানুষের বিবেক অন্যদের সাথে আচরণে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মানদণ্ড। যা আমরা পছন্দ করে না, তা যেন অন্যদের দান না করি।

 

২৬৮-২৬৯

আয়াতের শিক্ষণীয় দিক গুলো হলো-

প্রথমত : দারিদ্রের ভয়ে কৃপনতা করা উচিত নয়। কারণ, শয়তানই দারিদ্রের ভয় দেখায় যাতে আমরা দান-খয়রাত না করি। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করার মাধ্যমে দারিদ্রের ভয় মন থেকে দূর করতে হবে।

দ্বিতীয়ত : সুস্থ বিবেকের অধিকারী ব্যক্তি শয়তানের প্রলোভন ও কুমন্ত্রণায় কান না দিয়ে আল্লাহর ওয়াদায় বিশ্বাস করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সেই জ্ঞানী যে আল্লাহর অনুগত। যে নিজের খেয়াল খুশী তথা প্রবৃত্তি, শয়তান ও খোদা বিরোধী লোকদের অনুসরন করে তাকে প্রকৃত জ্ঞানী বলা যায় না।

 

২৭০-২৭১ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : আল্লাহ আমাদের দানের খবর রাখেন। তাই সবচেয়ে ভালো সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করতে হবে এবং দানের উদ্দেশ্য হতে হবে সবচেয়ে মহৎ আর সবচেয়ে মহৎ উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

দ্বিতীয়ত : দান করতে হবে কখনো প্রকাশ্যে এবং কখনো গোপনে। প্রকাশ্য-দানে অন্যরা দান করতে উৎসাহী হয়। আর গোপনে দানের মাধ্যমে অহংকার ও নিজেকে জাহির করা থেকে দূরে থাকা যায়।

তৃতীয়ত : দান-খয়রাত হলো গোনাহ মাফ বা ক্ষমা লাভের একটি মাধ্যম। তওবা ও ক্ষমা লাভের জন্য অনেক সময় দান খয়রাত করা উচিত যাতে আল্লাহ আমাদের গোনাহ বা পাপ ক্ষমা করে দেন।

 

২৭২ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা যাবে না, এমনকি নবীরাও কাউকে ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন না।

দ্বিতীয়ত : ইসলাম মানব সেবার ধর্ম। কোন অমুসলিমও দরিদ্র থাকুক ইসলাম তা চায় না।

তৃতীয়ত : কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে, তাহলে সে তার সৎ কাজের প্রতিদান পৃথিবীতে ও পরকালে অবশ্যই পাবে।

 

২৭৩ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : ধনীদের সম্পদের মধ্যে আল্লাহ দরিদ্রদের অধিকার রেখেছেন।

দ্বিতীয়ত : মুসলিম সমাজে দরিদ্ররা তাদের অভাবের কথা বলার আগেই যেন তাদের অভাব মেটানো হয়। এতে করে মুমিনের সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। মুসলিম সমাজে মুমিনের সম্মান ক্ষুন্ন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।