কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২২
প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ৮
সূরা আত তাকাসুর
কুরআনের ১০২ তম সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৮ টি এবং রূকুর সংখ্যা ১। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। আত তাকাসুর অর্থ প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা।
নামকরণ :
প্রথম আয়াত থেকে আততাকাসুরকে ( اَلۡهٰکُمُ التَّکَاثُرُ ) এই সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
শানে নুযুল
ইবনে আবু হাতেম আবু বুরাইদার রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছেঃ বনী হারেসা ও বনিল হারস নামক আনসারদের দুটি গোত্রের ব্যপারে এ সূরাটি নাযিল হয়। উভয় গোত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে প্রথমে নিজেদের জীবিত লোকদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে। তারপর কবরস্থানে গিয়ে মৃত লোকদের গৌরবগাঁথা বর্ণনা করে। তাদের এই আচরণের ফলে আল্লাহ্র এই বাণী নাযিল হয়। কিন্তু শানে নূযুলের জন্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তাকে এই সূরা নাযিলের উপলক্ষ বলে মেনে নেবার সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। বরং এ থেকে এই অর্থ গ্রহণ করা যায় যে , এই দু’টি গোত্রের কর্মকাণ্ডের সাথে সূরাটি খাপ খেয়ে যায়।
আবদুল আযীয ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্নিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যদি আদম সন্তানের স্বর্ণে পরিপূর্ন একটা উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দুটি উপত্যকার কামনা করবে। তার মুখ একমাত্র মাটি ছাড়া অন্য কিছুই ভরতে পারবে না। অবশ্য যে ব্যাক্তি তওবা করে, আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করেন। অন্য এক সুত্রে আনাস (রাঃ) উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ননা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমাদের ধারণা ছিল যে, সম্ভবত এ কুরআনেরই আয়াত। অবশেষে (সূরায়ে তাকাসুর) নাযিল হল। বুখারী ৫৯৯৬
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এই সূরায় মানুষকে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাস ও বৈষয়িক স্বার্থ পূজার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এই ভালোবাসা ও স্বার্থ পূজার কারণে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বেশী বেশী ধন – সম্পদ আহরণ , পার্থিব লাভ , স্বার্থ উদ্ধার , ভোগ প্রতিপত্তি , ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ এবং তার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একজন আর একজনকে টপকে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব অর্জন করার ব্যাপারে অহংকারে মতো থাকে। এই একটি মাত্র চিন্তা তাদেরকে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যার ফলে এর চেয়ে উন্নততর কোন জিনিসের প্রতি নজন দেবার মানসিকতাই তাদের নেই । এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে , এই যেসব নিয়ামত তোমরা নিশ্চিন্তে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত , এগুলো শুধুমাত্র নিয়ামত নয় বরং এগুলো তোমাদের জন্য পরীক্ষার বস্তুও । এগুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটি নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সুরার ফযিলত
রসূলে করীম একবার সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্যে কারও এমন ক্ষমতা নেই যে, এক হাজার আয়াত পাঠ করবে। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ হাঁ, এক হাজার আয়াত পাঠ করার শক্তি কয়জনের আছে। তিনি বললেনঃ তোমাদের কেউ কি সূরা তাকাছুর পাঠ করতে পারবে না? (মিশকাতুল মাসাবীহ ২১৮৪)। উল্লেখ্য এই যে, দৈনিক এই সূরা পাঠ করা এক হাজার আয়াত পাঠ করার সমান। [তাফসিরে মাযহারী]
আগের ও পরের সূরার সাথে সম্পর্ক
আগের ১০০ নং সূরা আল আদিয়াত এ রবের প্রতি অকৃতজ্ঞা, বেশি বেশি ধন-সম্পদ এর লোভে মত্ততা প্রকাশ পেয়েছে। তার পরের ১০১ নংসূরা আল ক্বরিয়াহ তে কিয়ামতের ভয়াবহতা প্রকাশিত হয়েছে। অকৃতজ্ঞতা, লোভ ছেড়ে ভালো কাজের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিয়ামতের ভয়াবহতা জেনেও মানুষ তা ভুলে থেকে ধন-সম্পদের লোভে মত্ত রয়ে যায়! এটি বর্নিত আছে এই ১০২ নং সূরা আত তাকাসূর এ।
৯৯-১০২ এই ৪ টি সূরায় আখিরাত ও দুনিয়ার কথা পরপর এসেছে। ৯৯ তম সূরা আল যিলযালে আখিরাতের কথা ১০০ তম সূরা আল আদিয়াতে দুনিয়া বিষয়ক। তেমনি ১০১ তম সূরা আল ক্বরিয়াহ তে আবার আখিরাতের কথা১০২ তম সূরা আত তাকাসুর আবার দুনিয়া বিষয়ক। এভাবে আখিরাত, দুনিয়া, আবার আখিরাত, আবার দুনিয়া এর বিষয় নিয়ে এসে মানুষকে বারবার সাবধান করেছেন এবং দুনিয়ার সাথে যে আখিরাত অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত তা বোঝাতে চেয়েছেন।
ألهى ‘আলহা’ শব্দটির মূলে রয়েছে لهو বা ‘লাহও’। এর আসল অর্থ গাফলতিতে নিমজ্জিত করা, ভুলিয়ে দেয়া। যেসব কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আকর্ষণ এত বেশী বেড়ে যায় যে সে তার মধ্যে মগ্ন হয়ে অন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল হয়ে পড়ে সেই ধরনের প্রত্যেকটি কাজের জন্য আরবী ভাষায় এ শব্দটি বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘তাকাসুর’ তোমাদেরকে তার নিজের মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে নিয়েছে, যার ফলে তার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা তোমাদের তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আখেরাত ও তার জন্য প্রস্তুতি থেকে গাফেল করে দিয়েছে। তার মোহ তোমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তারই চিন্তায় তোমরা নিমগ্ন। আর এই মোহ ও নিমগ্নতা তোমাদেরকে একেবারে গাফেল করে দিয়েছে। আয়াতে এর জন্য কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে।
তাকাসুর ( تَكَاثُر) এর মূল কাসরাত ৷ এর তিনটি অর্থ হয়৷ এক, মানুষের বেশী বেশী প্রাচুর্য লাভ করার চেষ্টা করা ৷ দুই, প্রাচুর্য লাভ করার জন্য মানুষের পরস্পরের অগ্রবর্তী হওয়ার চেষ্টা করা৷ তিন, লোকদের অন্যের তুলনায় বেশী প্রাচুর্য লাভ করার কথা নিয়ে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করে বেড়ানো৷ তাকাসুর অর্থ ব্যাপক; প্রাচুর্যে মাল-ধন, সন্তান-সন্ততি, সহযোগী-পৃষ্ঠপোষক, বংশ-গোত্র প্রভৃতি সবই শামিল।
কাজেই “আলহাকুমুত তাকাসুরের” অর্থ দাঁড়ায় তাকাসুর বা প্রাচুর্য তোমাদেরকে তা নিজের মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে নিয়েছে, যার ফলে তার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা তোমাদের তার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে ৷ ‘তাকাসুরের মধ্যে কোন জিনিসের প্রাচুর্য রয়েছে, ‘ আলহাকুম ‘ এ কোন জিনিস থেকে গাফেল হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং আলহাকুম এ কাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে – এ বাক্যে সে কথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি৷ অর্থের এই অস্পষ্টতার কারণে এই শব্দগুলো ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহারের দুয়ার খুলে গেছে৷ এ ক্ষেত্রে ‘ তাকাসুর ‘ বা প্রাচুর্যের অর্থ সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি৷ বরং দুনিয়ার সমস্ত সুবিধা ও লাভ , বিলাস দ্রব্য , ভোগের সামগ্রী , শক্তি ও কর্তৃত্বের উপকরণ বেশী বেশী অর্জন করার প্রচেষ্টা চালানো , এগুলো অর্জন করার জন্য একে অন্যের থেকে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করা এবং এগুলোর প্রাচুর্যের কারণে পরস্পরের মোকাবেলায় বড়াই করা এর অর্থের অন্তরভুক্ত হয়ে গেছে৷ অনুরূপভাবে ‘ আলহাকুম ‘ – এ যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি৷ বরং প্রত্যক যুগের লোকেরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও সামুগ্রিকভাবে এর সম্বোধনের আওতাভুক্ত হয়েছে৷ এর অর্থ দাঁড়ায় , বেশী বেশী বৈষয়িক স্বার্থ অর্জন করা , তার মধ্যে একে অন্যের অগ্রবর্তী হওয়া এবং অন্যের মোকাবেলায় তা নিয়ে গর্ব করার মোহ যেমন ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আচ্ছন্ন করে গোত্র ও জাতিকেও৷ অনুরূপভাবে ‘আলহাকুমুত তাকাসুর’ – এ যেহেতু একথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি যে , প্রাচুর্য লোকদেরকে নিজের মধ্যে নিমগ্ন করে কোন জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে , তাই এর অর্থের মধ্যেও ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে৷ এর অর্থ হচ্ছে , এই প্রাচুর্যের মোহ লোকদেরকে এর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেকটি জিনিস থেকে গাফেল করে দিয়েছে৷ তারা আল্লাহ থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ আখেরাত থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ নৈতিকতার সীমা ও নৈতিক দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে গেছে৷ অধিকারীর অধিকার এবং তা আদায় করার ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফেল হয়ে গেছে ৷ তারা নিজেদের জীবন যাপনের মান উন্নয়নের চিন্তায় ব্যাকুল ৷ মানবতার মান কত নেমে যাচ্ছে সে চিন্তা তাদেরকে একটুও ব্যতিব্যস্ত করে না৷ তাদের চাই বেশী বেশী অর্থ ৷ কোন পথে এ অর্থ অর্জিত হচ্ছে তার কোন পরোয়াই তাদের নেই৷ তারা বিলাস দ্রব্য ও ভোগের সামগ্রী বেশী বেশী চায়৷ এই প্রবৃত্তি পূজার লিপ্ত হয়ে তারা এহেন আচরণের পরিণাম থেকে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে গেছে৷ তারা বেশী বেশী শক্তি , সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের চিন্তায় মশগুল৷ এ প্রশ্নে তারা একে অপরের ডিঙ্গিয়ে যাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ তারা এ চিন্তা করছে না যে , এগুলো আল্লাহর দুনিয়াকে জুলুমে পরিপূর্ণ করার এবং মানবতাকে ধবংস ও বরবাদ করার সরঞ্জাম মাত্র ৷ মোটকথা , এভাবে অসংখ্য ধরনের ‘ তাকাসুর ‘ ব্যক্তি ও জাতিদেরকে তার মধ্যে এমনভাবে মশগুল করে রেখেছে যে , দুনিয়া এবং বৈষয়িক স্বার্থ ও ভোগের চাইতে বড় কোন জিনিসের কথা তারা মুহূর্তকালের জন্য চিন্তা করে না৷
আব্দুল্লাহ ইবনে শিখ্খীর (রাঃ) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এলাম, এমতাবস্থায় যে, তিনি ‘আলহাকুমুত তাকাসুর’ অর্থাৎ, প্রাচুর্য্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন ক’রে রেখেছে। (সূরা তাকাসুর) পড়ছিলেন। তিনি বললেন, আদম সন্তান বলে, ‘আমার মাল, আমার মাল।’ অথচ হে আদম সন্তান! তোমার কি এ ছাড়া কোন মাল আছে, যা তুমি খেয়ে শেষ ক’রে দিয়েছ অথবা যা তুমি পরিধান ক’রে পুরাতন করে দিয়েছ অথবা সাদকাহ ক’রে (পরকালের জন্য) জমা রেখেছ। (মুসলিম ৭৬০৯, ৭৬১১)
আমর ইবনে আউফ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আবূ উবাইদাহ ইবনে জাররাহকে জিযিয়া (ট্যাক্স) আদায় করার জন্য বাহরাইন পাঠালেন। অতঃপর তিনি বাহরাইন থেকে (প্রচুর) মাল নিয়ে এলেন। আনসারগণ তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে শরীক হলেন। যখন তিনি নামায পড়ে (নিজ বাড়ি) ফিরে যেতে লাগলেন, তখন তারা তাঁর সামনে এলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে দেখে হেসে বললেন, আমার মনে হয়, তোমরা আবূ উবাইদাহ বাহরাইন থেকে কিছু (মাল) নিয়ে এসেছে, তা শুনেছ। তারা বলল, জী হ্যাঁ। তিনি বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং তোমরা সেই আশা রাখ, যা তোমাদেরকে আনন্দিত করবে। তবে আল্লাহর কসম! তোমাদের উপর দারিদ্র্য আসবে আমি এ আশংকা করছি না বরং আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদেরও পার্থিব জীবনে প্রশস্ততা আসবে। আর তাতে তোমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেমন তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অতঃপর তা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। (বুখারী ৪০১৫, মুসলিম ২৯৬১)
এর অর্থ হল, অধিকাধিক (মাল-ধন) উপার্জন করার উদ্দেশ্যে পরিশ্রম করতে করতে মৃত্যু তোমাদেরকে গ্রাস করে ফেলল এবং শেষ পর্যন্ত তোমরা কবরে গিয়ে পৌঁছলে!
مَقَابِر একবচনে مَقْبرةً অর্থ কবরস্থান। القُبُوْر একবচনে القَبْر ‘কবর’। জানা আবশ্যক যে, দুনিয়াবী জীবনের সমাপ্তি হিসাবে এখানে কবরের কথা বলা হয়েছে। নইলে কবর মানুষের জন্য চূড়ান্ত ঠিকানা নয়। বরং এটি জীবনের সফরসূচীর তৃতীয় পর্যায় বা দারুল বারযাখ। অর্থাৎ পর্দার অন্তরালের যাত্রী বিশ্রামাগার বা Waiting room মাত্র। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ ‘আর তাদের সম্মুখে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। অর্থাৎ এটি দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী অবস্থান এবং কবর হ’ল আখেরাতের প্রথম মনযিল। এর পরবর্তী চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা বা দারুল ক্বারার হ’ল জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করে তার জন্য কতিপয় স্তর, কাল, স্থান ও অবস্থার বন্দোবস্ত করেছেন, যেগুলি তাকে অতিক্রম করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সে জান্নাত বা জাহান্নামে স্থায়ী হয়ে যায়। মানুষ যেসব স্তর অতিক্রম করে, সেগুলি চারটি: মানব জীবনের সফরসূচী শুরু হয় প্রথমে আল্লাহর নিকট থেকে মায়ের গর্ভে। এটা হ’ল প্রথম মনযিল। এখানে সাধারণতঃ ৯ মাস ১০ দিন থাকার পর ভূমিষ্ট হয়ে সে দুনিয়াতে আসে। এটা হ’ল দ্বিতীয় মনযিল বা ‘দারুদ্দুনিয়া’। এখানে সে কমবেশী ৭০ বছর অবস্থান করে। রাসূল (সাঃ ) বলেন, আমার উম্মতের আয়ু ষাট হ’তে সত্তুর বছরের মধ্যে হবে। খুব কম সংখ্যকই তা অতিক্রম করবে’। অতঃপর নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মৃত্যু ও কবরে গমন। এটা হ’ল তৃতীয় মনযিল বা ‘দারুল বারযাখ’। এখান থেকে তার আখেরাতের সফর শুরু হয়। যা শেষ হবে ক্বিয়ামতের দিন। কবর তার জন্য জান্নাতের টুকরা হবে বা জাহান্নামের গর্ত হবে। অতঃপর ক্বিয়ামতের দিন পুনরুত্থান শেষে সেখানে মানুষের তিনটি সারি হবে। অগ্রগামী দল, ডাইনের সারি ও বামের সারি। প্রথম দু’টি দল জান্নাতী হবে ও বামের সারি জাহান্নামী হবে। এটি হ’ল চতুর্থ মনযিল বা ‘দারুল ক্বারার’। যা হ’ল চূড়ান্ত ঠিকানা।
অর্থাৎ তোমরা ভুল ধারণার শিকার হয়েছো৷ বৈষয়িক সম্পদের এ প্রাচুর্য এবং এর মধ্যে পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হয়ে যাওয়াকেই তোমরা উন্নতি ও সাফল্য মনে করে নিয়েছো৷ অথচ এটা মোটেই উন্নতি ও সাফল্য নয় ৷ শীঘ্রই তোমরা এর অশুভ পরিণতি জানতে পারবে৷ সারাটা জীবন যে ভুলের মধ্যে তোমরা লিপ্ত ছিলে সেটা যে কত বড় ভুল ছিল তা তোমরা শীঘ্রই জানতে পাবে৷ শীঘ্রই অর্থ আখেরাতে ও হতে পারে৷ কারণ আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সমগ্রকাল ব্যাপী যে সত্তার দৃষ্টে প্রসারিত তাঁর কাছে কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ বছর ও কালের সামান্য একটি অংশ মাত্র৷ কিন্তু এর অর্থ মৃত্যুও হতে পারে৷ কারণ কোন মানুষ থেকে তার অবস্থান বেশী দূরে নয়৷ আর মানুষ তার সারা জীবন যে সব কাজের মধ্যে কাটিয়ে এসেছে সে মরে যাবার সাথে সাথেই সেগুলো তার জন্য সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ও অশুভ পরিণামের বাহন ছিল কিনা তা তার কাছে একেবারে সুষ্পষ্ট হয়ে যাবে৷
كَلاَّ পরপর দু’বার আনা হয়েছে শ্রোতাকে ধমক দেওয়ার জন্য ও সতর্ক করার জন্য। এটি كلمة ردع বা প্রত্যাখ্যানকারী শব্দ। এর মাধ্যমে বান্দার লোভের আধিক্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এর দ্বারা বলতে চাওয়া হয়েছে যে, প্রাচুর্যের লোভ করো না। পরিণামে তোমরা লজ্জিত হবে। যা তোমরা সত্বর জানতে পারবে। হাসান বাছরী বলেন, هذا وعيد بعد وعيد ‘এটি ধমকের পরে ধমক’ (ইবনু কাছীর)। দু’বার আনার অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, প্রথমটি দ্বারা কবর এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা আখেরাত বুঝানো হয়েছে। অথবা প্রথমটিতে বলা হয়েছে, তোমরা সত্বর জানতে পারবে যখন মৃত্যু এসে যাবে ও তোমাদের রূহ তোমাদের দেহ থেকে টেনে বের করা হবে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, পুনরায় তোমরা জানতে পারবে যখন তোমরা কবরে প্রবেশ করবে এবং মুনকার-নাকীর তোমাদের প্রশ্ন করবে’। অথবা প্রথমটি দ্বারা ক্বিয়ামত এবং শেষেরটি দ্বারা হাশর অর্থাৎ বিচার দিবস বুঝানো হয়েছে (কুরতুবী)।
তৃতীয়বার كَلاَّ এনে বান্দাকে কঠোর হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হয়েছে, যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে! কেননা ক্বিয়ামত ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকলে তোমরা কখনোই অধিক অর্থ-বিত্ত ও প্রাচুর্যের পিছনে ছুটতে না। এখানে لَوْ (যদি) এর জবাব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ যদি তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে আজকে নিশ্চিত জানতে যা পরে জানবে, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত থেকে গাফেল হ’তে না। ইবনু আবী হাতেম বলেন, তিনটি স্থানেই كَلاَّ অর্থ أَلاَ অর্থাৎ ‘সাবধান’। ফার্রা বলেন, বরং كَلاَّ অর্থ হবে حقًّا ‘অবশ্যই’। অর্থাৎ অবশ্যই তোমরা ক্বিয়ামত সম্পর্কে সত্বর জানতে পারবে (কুরতুবী)।
عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ: বিদ্যার্জন ও জ্ঞান লাভের দ্বারা অন্তরে যে বিশ্বাস ও প্রত্যয় সৃষ্টি হয়, তাকেই বলা হয় ইলমুল
ইয়াকীন বা জ্ঞানলব্ প্রত্যয় । উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মানুষ সম্পর্কে আফসোস করে বলেছেন, তোমরা জাগতিক জীবনে অধিক মাত্রায় ধন-সম্পদ, প্রাচুর্য, মান-মর্যাদা ও নেতৃত্ব লাভের নেশায় মোহান্ধ হয়ে পড়েছ এবং একেও জীবনের উন্নতি ওসাফল্য ভাবছ; কিন্তু তা কখনই মানুষের জীবনের আসল উন্নতি ও সাফল্য হতে পারে না; বরং আল্লাহকে ভুলে এ সব ধান্দায়থাকার পরিণতি যে কত মারাত্মক ও ধ্ৰংসাত্বক, এ বিষয় যদি তোমরা জ্ঞান দ্বারা নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করতে, তবে তাতোমাদের পক্ষেই ফলপ্রসূ হতো । আয়াতে ওহীলন্ধ জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান ও নেক আমল করার দিকে ইঙ্গিত প্রদানকরা হয়েছে।
ইমাম কাতাদাহ রে.) বলেছেন, আমরা এ বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করতাম যে, আলোচ্য আয়াতের عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এ বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করা যে, মৃত্যুর পর অবশাই আল্লাহ পুনজীবন দান করবেন এবং পুনরুথান করবেন।
আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথি (র.) লিখেছেন, ইলমুল ইয়াকীন হলো- অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা। [নূরুল কোরআন]
এটি পূর্ববর্তী আয়াতের لَوْ (যদি)-এর জবাব নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ পৃথক ও শপথসূচক বাক্য। শুরুতে وَاللهِ (আল্লাহর কসম) উহ্য রয়েছে। لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ হ’ল উক্ত শপথের জওয়াব। এর সাথে পূর্বের আয়াতের কোন সম্পর্ক নেই।
এটিতে প্রচ্ছন্নভাবে আরেকবার ধমক দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে শপথ লুকিয়ে রয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তোমরা অবশ্যই জা হান্নামকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করবে। তখন তোমাদের মধ্যে দিব্য-প্রত্যয় জন্মাবে।
এখানে ‘তোমরা’ বলে কাফেরদের বুঝানো হ’তে পারে। কেননা তাদের জন্যে জাহান্নাম অবধারিত। অথবা সাধারণভাবে সকল বনু আদমকে বুঝানো হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় (জাহান্নামে) পৌঁছবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য ফায়ছালা’ (মারিয়াম ১৯/৭১)। এখানে পৌঁছানোর অর্থ প্রবেশ করা নয়, বরং অতিক্রম করা। একে ‘পুলছিরাত’ বলা হয়। ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, মুমিনগণ পুলছিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে বিদ্যুতের বেগে, জাহান্নামের কোন উত্তাপ তারা অনুভব করবে না। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ আটকে যাবে ও জাহান্নামে পতিত হবে…। যেমন পরের আয়াতেই আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমরা আল্লাহভীরুদের উদ্ধার করব এবং যালেমদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (মারিয়াম ১৯/৭২)। অতএব মুমিন-কাফির সবাই জাহান্নামকে প্রত্যক্ষ করবে। মুমিনগণ সহজে পার হয়ে যাবে। কিন্তু কাফের-ফাসেকগণ জাহান্নামে পতিত হবে।
এখানে عَيْنَ الْيَقِيْنِ বা ‘দিব্য-প্রত্যয়ে’ বলার কারণ এই যে, মানুষ চোখে দেখাটাকে অধিক গুরুত্ব দেয় কানে শোনার চাইতে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) বলেন, لَيْسَ الْخَبَرُ كَالْمُعَايَنَةِ ‘শোনা খবর কখনো চোখে দেখার সমান নয়’। الْعَيْنُ অর্থ النَّفْسُ। ফলে দেখাটাকেই ইয়াক্বীন গণ্য করা হয়েছে’ (ক্বাসেমী)।
দুনিয়াতে ঈমানদারগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথায় বিশ্বাসী হয়ে মনের চোখ দিয়ে সেটা দেখতে পারে এবং আখেরাতে মানুষ সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। কিন্তু তখনকার দিব্য-প্রত্যয়ে কোন কাজ হবে না (সাজদাহ ৩২/২৯)। দুনিয়াতে বিশ্বাস করলে ও সেই অনুযায়ী সাবধান হয়ে নেক আমল করলে আখেরাতে কাজে লাগবে (মুল্ক ৬৭/২; যিলযাল ৯৯/৭-৮)। ফলে সেদিন জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেও আল্লাহর হুকুমে সেখানে সে পতিত হবে না। বরং সহজে পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। দুঃখ হয় মানুষের জন্য যে, সে নিজে না দেখেও অন্যের কথা শুনে নিজের মৃত মাতা-পিতা ও দাদা-দাদীর উপরে ঈমান এনে থাকে। অথচ সে নবী-রাসূলের কথা শুনে আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান আনতে পারে না।
কোনো জিনিস জানার তিনটি স্তর বয়েছে-
১. عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ (ইলমুল ইয়াক্বীন) ২. عَيْنَ الْيَقِيْنِ (আইনাল ইয়াক্বীন) এবং ৩. حقاليقين (হাক্কাল ইয়াক্বীন) যেমন- কেউ বিশ্বস্ত মাধ্যমে জানতে পারুল যে, আঙুর ফল মিষ্ট একে বলে عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ (ইলমুল ইয়াক্বীন) এরপর সে এটা চোখে দেখে বুঝতে পারল যে. এটা মিষ্টি হবে, তাকে বলে عَيْنَ الْيَقِيْنِ (আইনাল ইয়াক্বীন) সে তা ভক্ষণ করে তার স্বাদ গ্রহণ করল, তাকে বলে حقاليقين । [তাফসীরে জালালাইন]
এই বাক্যে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এই অর্থে ‘ তারপর ‘ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি৷ বরং এর অর্থ হচ্ছে : তারপর এ খবরটিও আমি তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি যে , এসব নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে ৷ আর একথা সুষ্পষ্ট , আল্লাহর আদালতে হিসেব নেবার সময় এ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷ এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে এই যে , বিভিন্ন হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে , তিনি বলেছেন , মহান আল্লাহ বান্দাদেরকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন সে সম্পর্কে মু’মিন ও কাফের সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে৷ এটা আলাদা ব্যাপার যারা নিয়ামত অস্বীকার করেনি এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে জীবন যাপন করেছে তারা এই জিজ্ঞাসাবাদে সফলকাম হবে৷ আর যারা আল্লাহর নিয়ামতের হক আদায় করেনি এবং নিজেদের কথা ও কাজের মাধ্যমে অথবা উভয়ের সাহায্যে তাঁর নাফরমানি করেছে তার ব্যর্থ হবে৷
কুরআন ও হাদীসের অন্যত্র এরকম কিছু নেয়ামতের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। অন্য আয়াতে এভাবে করা হয়েছে, (إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا) “কান, চোখ, হৃদয়- এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” [সূরা আল-ইসরা: ৩৬] এতে মানুষের শ্রবণশক্তি দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয় সম্পর্কিত লাখো নেয়ামত অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যেগুলো সে প্রতি মুহুর্তে ব্যবহার করে। বিভিন্ন হাদীসেও নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার কথা স্পষ্টভাবে এসেছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দু’টি নেয়ামত এমন আছে যাতে অধিকাংশ মানুষই ঠক খায়। তার একটি হলো, স্বাস্থ্য অপরটি হচ্ছে অবসর সময়।” [বুখারী: ৬৪১২]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ আয়াত নাযিল হলে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা কোন নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হব? এটা তো শুধু (আসওয়াদান বা দুই কালো জিনিস) খেজুর ও পানি। রাসূল বললেন, “অবশ্যই তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” [তিরমিযী: ৫/৪৪৮, ইবনে মাজাহ: ৪১৫৮, মুসনাদে আহমাদ: ৩/২৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন প্রথম যে নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তা হচ্ছে, আমি কি তোমাকে শারীরিকভাবে সুস্থ করিনি? আমি কি তোমাকে সুপেয় পানি পান করাইনি?” [তিরমিযী: ৩৩৫৮] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, আদম সন্তান! তোমাকে ঘোড়া ও উটে বহন করিয়েছি, তোমাকে স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোমাকে ঘুরাপিরা ও নেতৃত্ব করার সুযোগ দিয়েছি, এগুলোর কৃতজ্ঞতা কোথায়?” [মুসলিম: ২৯৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৯২]
এই হাদীসগুলো থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জিজ্ঞাসাবাদ কেবল কাফেরদেরকে করা হবে না, সৎ মুমিনদেরকেও করা হবে। আর আল্লাহ মানুষকে যে নিয়ামতগুলো দান করেছেন সেগুলো সীমা সংখ্যাহীন। সেগুলো গণনা করা সম্ভব নয়। বরং এমন অনেক নিয়ামতও আছে যেগুলোর মানুষ কোন খবরই রাখে না। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, “যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতগুলো গণনা করতে থাকো তাহলে সেগুলো পুরোপুরি গণনা করতেও পারবে না।” [সূরা ইবরাহীম: ৩৪]
নিম্নে আমরা মানুষের প্রধান প্রধান নে‘মত সমূহ, যা পবিত্র কুরআনে ও সহীহ হাদীস সমূহে উল্লেখিত হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির কথা উল্লেখ করব।–
১. চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় : আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৩৬)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) النَّعِيْمِ -এর ব্যাখ্যায় বলেন, এটা হ’ল দেহ, কর্ণ ও চক্ষুর সুস্থতা।
২. স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা : আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) এরশাদ করেন, ‘দু’টি নে‘মত রয়েছে, যে দু’টিতে বহু মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়েছে- স্বাস্থ্য এবং সচ্ছলতা’। অর্থাৎ যখন সে সুস্থ ও সচ্ছল থাকে, তখন এ দু’টি নে‘মতকে সে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে ব্যয় করে না। বরং অলসতা করে এবং এখন নয়, পরে করব বলে শয়তানী ধোঁকায় পতিত হয়। ফলে যখন সে অসুস্থ হয় বা অসচ্ছল হয় কিংবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আর ঐ নেকীর কাজটি করার সুযোগ থাকে না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘তুমি পাঁচটি বস্ত্তর পূর্বে পাঁচটি বস্ত্তকে গণীমত (সম্পদ) মনে কর : (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে (২) পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে (৩) দরিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে (৪) ব্যস্ততার পূর্বে অবসর সময়কে এবং (৫) মৃত্যুর পূর্বে তোমার জীবনকে’।
(৩) সম্পদ, সন্তান ও নেতৃত্ব : আবু হুরায়ারা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, আমি কি তোমাকে কান, চোখ, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেইনি?… আমি কি তোমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ও গণীমতের মাল নেওয়ার জন্য ছেড়ে দেইনি?’[তিরমিযী হা/২৪২৮ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৬৪৬৩।] অত্র হাদীছে কান ও চোখ ছাড়াও ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও নেতৃত্বকে অন্যতম প্রধান নে‘মত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যে বিষয়ে তাকে ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে।
(৪) আত্মীয়-পরিজন, ব্যবসা ও বাড়ী-ঘর : পবিত্র কুরআনে আরও কয়েকটি বস্ত্তকে মানুষের প্রিয়বস্ত্ত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যেগুলি নিঃসন্দেহে আল্লাহর দেওয়া অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মত। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘বল তোমাদের নিকটে যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিবার ও গোত্র-পরিজন, তোমাদের মাল-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করে থাক, তোমাদের ব্যবসা-বানিজ্য যা তোমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা করে থাক এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ করে থাক, যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চাইতে এবং তাঁর পথে জিহাদের চাইতে তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয় হয়, তাহ’লে তোমরা প্রতীক্ষায় থাক, যে পর্যন্ত না আল্লাহ স্বীয় নির্দেশসহ আগমন করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা ৯/২৪)। উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত প্রতিটি নে‘মতের বিষয়ে বান্দাকে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে।
(৫) সদাসঙ্গী পুত্রগণ : এই সঙ্গে আরেকটি নে‘মতের কথা বলা হয়েছে। وَبَنِينَ شُهُودًا ‘সদাসঙ্গী পুত্রগণ’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৩)। অনেকের একাধিক পুত্র সন্তান আছে। কিন্তু কেউ পিতামাতার কাছে থাকেনা। এটা যথার্থ নে‘মত নয়। যে সন্তান সর্বদা পিতামাতার সুখ-দুঃখের সাথী থাকে, সেই-ই হ’ল প্রকৃত নে‘মত।
(৬) পুণ্যশীলা স্ত্রী : আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ ) এরশাদ করেন, إِنَّ الدُّنْيَا كُلَّهَا مَتَاعٌ وَخَيْرُ مَتَاعِ الدُّنْيَا الْمَرْأَةُ الصَّالِحَةُ- ‘নিশ্চয় সমগ্র দুনিয়াটাই সম্পদ। আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হ’ল পুণ্যবতী স্ত্রী’।[মুসলিম হা/১৪৬৭; মিশকাত হা/৩০৮৩ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।] এই শ্রেষ্ঠ নে‘মত কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করা হবে। তেমনি স্ত্রীকেও তার সংসারের গুরু দায়িত্ব পালন সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’।[ বুখারী হা/৮৯৩, মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।]
(৭) ক্ষুধায় অন্ন : একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুধায় কাতর হয়ে বের হলেন, পথে আবু বকর ও উমরও বের হলেন, তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন বের হয়েছ? তারা বলল, ক্ষুধা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার নফস তার শপথ, আমিও সে কারণেই বের হয়েছি। তারপর তিনি বললেন, চল। তারা সবাই এক আনসারীর বাড়ীতে আগমন করলেন। আনসারী লোকটির স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সঙ্গিদ্বয়কে দেখে যার-পর-নাই খুশী হয়ে শুভেচ্ছা ও স্বাগতম জানানোর মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অমুক কোথায়? স্ত্রী জানালো যে, সে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে গেছে।
ইত্যবসরে আনসারী লোকটি এসে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আজি কেউ আমার মত মেহমান পাবে না। তারা বসলে তিনি তাদের জন্য এক কাঁদি খেজুর নিয়ে আসলেন যাতে কাঁচা-পাকা, আধাপাকা, ভাল-মন্দ সব ধরণের খেজুর ছিল। তারপর আনসারী লোকটি ছুরি নিয়ে দৌড়াল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সাবধান! দুধ দেয় এমন ছাগল যাবাই করো না। আনসারী তাদের জন্য যবাই করলে তারা ছাগলের গোস্ত খেল, খেজুর গ্ৰহণ করল, পানি পান করল। তারপর যখন তৃপ্ত হলো তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর ও উমরকে বললেন, “তোমরা কিয়ামতের দিন এ সমস্ত নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তোমাদেরকে ক্ষুধা তোমাদের ঘর থেকে বের করল, তারপর তোমরা এমন নেয়ামত ভোগ করার পর ফিরে গেলে”। [মুসলিম: ২০৩৮]
বস্ত্ততঃপক্ষে উপরে বর্ণিত সকল বিষয়ই আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত। এগুলি সম্পর্কে বান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তারা দুনিয়ায় থাকতে এগুলির শুকরিয়া আদায় করেছিল, না কুফরী করেছিল। এই প্রশ্ন প্রত্যেক মানুষকেই করা হবে।
ফুটনোট
- এমন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা, যে বিষয় সমূহ মানুষকে হিসাবের দিন কে ভুলিয়ে রাখে।
- বেশি বেশি কবর জিয়ারত করা, জিয়ারত মানুষ কে সে দিনের কথা সরণ করিয়ে দেয় যে একদিন নিজের চির স্থায়ী ঠিকানা হবে এ কবর।
- জাহান্নাম থেকে রক্ষা চাওয়া,যেন এক সেকেন্ডের জন্য ও জাহান্নামের ধারে কাছে যেতে না হয়।
- আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আমাদের যেসব নিয়ামত দিয়েছেন সেগুলোকে যেন আমরা যথাযথ ব্যবহার করতে পারি কারণ কিয়ামতের দিন সেগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।
- আল্লাহ্ প্রদত্ত আমাদের প্রতি কয়েকটি নেয়ামত হলো- (১). চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় (২). স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা (৩) সম্পদ, সন্তান ও নেতৃত্ব (৪) আত্মীয়-পরিজন, ব্যবসা ও বাড়ী-ঘর (৫) সদাসঙ্গী পুত্রগণ (৬) পুণ্যশীলা স্ত্রী (৭) ক্ষুধায় অন্ন
- সে সময়ের জন্য দোয়া করা যে সময় এ পৃথিবীতে বিচরন করবে আমাদের উত্তরসূরী, তারা যেন আমাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আল্লাহ কবুল করে।
- কোনো জিনিস জানার তিনটি স্তর বয়েছে- ১. عِلۡمَ الۡیَقِیۡنِ (ইলমুল ইয়াক্বীন) ২. عَيْنَ الْيَقِيْنِ (আইনাল ইয়াক্বীন) এবং ৩. حقاليقين (হাক্কাল ইয়াক্বীন)
- মানুষ যেসব স্তর অতিক্রম করে, সেগুলি চারটি: মানব জীবনের সফরসূচী শুরু হয় প্রথমে আল্লাহর নিকট থেকে মায়ের গর্ভে। এটা হ’ল প্রথম মনযিল। দ্বিতীয় মনযিল বা ‘দারুদ্দুনিয়া’ এখানে সে কমবেশী ৭০ বছর অবস্থান করে। শেষে মৃত্যু ও কবরে গমন। এটা হ’ল তৃতীয় মনযিল বা ‘দারুল বারযাখ’। এখান থেকে তার আখেরাতের সফর শুরু হয়। এটি হ’ল চতুর্থ মনযিল বা ‘দারুল ক্বারার’।
- দৈনিক এই সূরা পাঠ করা এক হাজার আয়াত পাঠ করার সমান।
- كَلاَّ শব্দ তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে। পরপর দু’বার আনা হয়েছে শ্রোতাকে ধমক দেওয়ার জন্য ও সতর্ক করার জন্য। তিন নং বার উল্লেখ করা হয়েছে কঠিন হুশিয়ারী করার জন্য।