কুরআন অধ্যয়ন প্রতিযোগিতা ২০২৫
প্রস্তুতি সহায়ক তাফসীর নোট পর্বঃ ১০
সূরা জাসিয়াহ ১-১১ আয়াত
সূরা আল জাসিয়াহ কুরআনের ৪৫তম সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৩৭ এবং এর রূকু সংখ্যা ৪। সূরা আল জাসিয়াহ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সূরার নামের অর্থ নতজানু হওয়া হাঁটুতে ভর দেয়া।
নামকরণ:
২৮ আয়াতের وَتَرَى كُلَّ أُمَّةٍ جَاثِيَةً বাক্যাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এটি সেই সূরা যার মধ্যে ‘জাসিয়াহ’ শব্দ আছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল:
এ সূরাটির নাযিল হওয়ার সময়-কাল কোন নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তবে এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় এটি সুরা ‘দুখান’ নাযিল হওয়ার অল্প দিন পরই নাযিল হয়েছে। এ দুটি সূরার বিষয়বস্তুতে এতটা সাদৃশ্য বর্তমান যে সূরা দুটিকে যমজ বা যুগ্ম বলে মনে হয়।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সূরার বিষয়বস্তু হচ্ছে তাওহীদ ও আখেরাত সম্পর্কে মক্কার কাফেরদের সন্দেহ, সংশয় ও আপত্তির জবাব দেয়া এবং কুরআনের দাওয়াতের বিরুদ্ধে তারা যে নীতি ও আচরণ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে সতর্ক করা।
তাওহীদের সপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মানুষের নিজের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে, যেদিকেই চোখ মেলে তাকাও না কেন তোমরা যে তাওহীদ মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছো প্রতিটি বস্তু তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। নানা রকমের এসব জীব-জন্তু, এই রাতদিন, এই বৃষ্টিপাত এবং তার সাহায্যে উৎপন্ন উদ্ভিদ রাজি, এই বাতাস এবং মানুষের নিজের জন্ম এর সবগুলো জিনিসকে কোন ব্যক্তি যদি চোখ মেলে দেখে এবং কোনো প্রকার গোঁড়ামি বা অন্ধ আবেগ ছাড়া নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এসব নিদর্শন তার মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট যে এই বিশ্ব জাহান খোদাহীন নয় বা এখানে বহু খোদায়ী চলছে না, বরং এক আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই এর ব্যবস্থাপক ও শাসক। তবে যে ব্যক্তি মানবে না বলে শপথ করেছে কিংবা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে পড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কথা ভিন্ন। দুনিয়ার কোন জায়গা থেকেই সে ঈমান ও ইয়াকীনের সম্পদ লাভ করতে পারবে না।
দ্বিতীয় রুকূ’র শুরুতে বলা হয়েছে, এই পৃথিবীতে মানুষ যত জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করছে এবং এই বিশ্ব জাহানে যে সীমাসংখ্যাহীন বস্তু ও শক্তি তার স্বার্থের সেবা করছে তা আপনা আপনি কোথাও থেকে আসেনি বা দেব-দেবীরাও তা সরবরাহ করেনি, বরং এক আল্লাহই তাঁর নিজের পক্ষ থেকে তাকে এসব দান করেছেন এবং এসবকে তার অনুগত করে দিয়েছেন। কেউ যদি সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে তার বিবেক-বুদ্ধিই বলে দেবে, সেই আল্লাহই মানুষের প্রতি অনুগ্রহকারী মানুষ তাঁর শোকর গোজারী করবে এটা তাঁর প্রাপ্য।
এরপর মক্কার কাফেররা হঠকারিতা, অহংকার, ঠাট্টা-বিদ্রূপ এবং কুফরকে আঁকড়ে ধরে থেকে কুরআনের দাওয়াতের যে বিরোধিতা করছিলো। সে জন্য তাদেরকে কঠোরভাবে তিরস্কার করা হয়েছে এবং সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, এ কুরআন সেই নিয়ামত নিয়ে এসেছে যা ইতিপূর্বে বনী-ইসরাঈলদের দেয়া হয়েছিলো যার কল্যাণে বনী ইসরাঈলরা গোটা বিশ্বের সমস্ত জাতির ওপর মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলো। কিন্তু তারা এই নিয়ামতের অমর্যাদা করেছে এবং দ্বীনের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি করে তা হারিয়ে ফেলেছে। তাই এখন তা তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এটা এমন একটি হিদায়তনামা যা মানুষের দ্বীনের পরিষ্কার রাজপথ দেখিয়ে দেয়। নিজেদের অজ্ঞতা ও বোকামির কারণে যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে তারা নিজেদেরই ধ্বংসের আয়োজন করবে। আর আল্লাহর সাহায্য ও রহমতের উপযুক্ত বিবেচিত হবে কেবল তারাই যারা এর আনুগত্য করে তাকওয়ার নীতি ও আচরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
এ ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হয়েছে, এসব লোক আল্লাহকে ভয় করে না। এরা তোমাদের সাথে যে অশোভন আচরণ করছে তা উপেক্ষা করো এবং সহিষ্ণুতা অবলম্বন করো। তোমরা ধৈর্য অবলম্বন করলে আল্লাহ নিজেই এদের সাথে বুঝাপড়া করবেন এবং তোমাদের এই ধৈর্যের প্রতিদান দিবেন।
তারপর আখেরাত বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কাফেরদের জাহেলী ধ্যান-ধারণা আলোচনা করা হয়েছে এবং কাফেরদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও যুক্তির জবাব দেওয়া হয়েছে।
এসব যুক্তি-প্রমাণ পেশ করার পর আল্লাহ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, যেভাবে তোমরা নিজে নিজেই জীবন লাভ করোনি, আমি জীবন দিয়েছি বলে জীবন লাভ করছো, তেমনি নিজে নিজেই মরে যাবে না, বরং আমি মৃত্যু দিই বলে মারা যাও এবং এমন একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন তোমাদের সবাইকে যুগপৎ একত্র করা হবে। আজ যদি মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে তোমরা একথা না মানতে চাও তাহলে মেনো না। কিন্তু সে সময়টি যখন আসবে তখন নিজের চোখেই তোমরা দেখতে পাবে যে, তোমরা তোমাদের আল্লাহর সামনে হাজির আছো এবং কোনো প্রকার কমবেশী ছাড়াই তোমাদের পুরো আমলনামা প্রস্তুত আছে, যা তোমাদের প্রতিটি কাজের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সে সময় তোমরা জানতে পারবে আখেরাতের আকীদার এই অস্বীকৃতি এবং এ নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রূপ তোমরা করছো এর কত চড়া মূল্য তোমাদের দিতে হচ্ছে।
পূর্বের ও পরের সূরার সাথে সম্পর্ক
পূর্ববর্তী সূরার শেষে এমন গুণাবলির উল্লেখ রয়েছে যা মানবজীবনের সাফল্যের কারন হয়। এরপর একথা ঘোষণা করা হয় যে, কুরআনে কারীমকে আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়েছে, যাতে করে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে, এরপরও যদি কেউ হেদায়েত কবুল না করে তবে তা সে ব্যক্তির দুর্ভাগ্য ব্যতীত আর কিছুই নয়। আর এ প্রক্ষিতেই সূরা জাসিয়ার প্রারাম্ভে পবিত্র কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এর পাশাপাশি সৃষ্টিজগতে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ্ পাকের যেসব বিষ্ময়কর নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে, তার প্রতি লক্ষ্য করে ঈমান আনয়নের আহ্বান জানানো হয়েছে। সূরা জাসিয়াহ-তে কুরআনের বিষয়ে আলোচনা রয়েছে এবং সূরার শেষের দিকে কিয়ামতের সত্যতার ঘোষণা রয়েছে আর পরবর্তী সূরা আহক্বাফে সূচনাতেই কুরআনের সত্যতা এবং কেয়ামতের আলোচনা রয়েছে।
“হুরূফুল মুক্বাত্বআ” কুরআনের ২৯টি সূরার শুরুতে ব্যবহৃত ১৪টি বিশেষ বর্ণ নিয়ে গঠিত, যা বিভিন্ন সংমিশ্রণে এসেছে। এগুলো এক থেকে পাঁচটি বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। এক অক্ষরের উদাহরণ হলো ق (ক্বাফ) এবং ن (নূন), দুই অক্ষরের মধ্যে আছে طه (ত্বা-হা) ও يس (ইয়াসীন), তিন অক্ষরের উদাহরণ الم (আলিফ-লাম-মীম), চার অক্ষরের كهيعص (কাফ-হা-ইয়া-আইন-সাদ), এবং পাঁচ অক্ষরের মধ্যে রয়েছে حم عسق (হা-মীম-আইন-সীন-ক্বাফ)। যেসব সূরাগুলো এই অক্ষরগুলো দ্বারা শুরু হয়, সেগুলো আসলে কুরআনের অলৌকিকতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা প্রমাণ করে । এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
এটা এই সূরার সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। এতে শ্রোতাদেরকে দু’টি বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।এর একটি বিষয় হচ্ছে, এ কিতাব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা নয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কিতাব নাযিল করছেন আল্লাহ, যিনি মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী। তাঁর মহাপরাক্রমশালী হওয়ার দাবী হলো, মানুষ যেন তাঁর আদেশের অবাধ্য হওয়ার দুঃসাহস না দেখায়। কারণ অবাধ্য হয়ে সে তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। তাঁর মহাজ্ঞানী হওয়ার দাবী হলো মানুষ পূর্ণ মানসিক প্রশান্তিসহ স্বেচ্ছায় আগ্রহ নিয়ে তাঁর হিদায়াত ও আদেশ-নিষেধ পালন করবে। কারণ, তাঁর শিক্ষা ভ্রান্ত, অসঙ্গত ও ক্ষতিকর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
ভূমিকার পর মূল বক্তব্য এভাবে শুরু করায় স্পষ্ট বুঝা যায় এর পটভূমিতে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার বিরুদ্ধে মক্কার লোকদের পেশকৃত আপত্তিসমূহ। তারা বলতোঃ আজ পর্যন্ত যেসব সম্মানিত সত্তার আস্তানার সাথে আমাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা জড়িত তারা সবাই তুচ্ছ, নগণ্য আর সার্বভৌম কর্তৃত্ব শুধু এক মাত্র আল্লাহর, এক ব্যক্তির কথায় এত বড় একটা জিনিস আমরা কী করে মেনে নেই। এর জবাবে বলা হচ্ছে, যে সত্যটি মানার জন্য তোমাদের আহবান জানানো হচ্ছে সারা বিশ্বজাহান তার সত্যতার নিদর্শনে ভরা। চোখ মেলে দেখো। তোমাদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র শুধু নিদর্শনে ভরা। চোখ মেলে দেখো। তোমাদের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র শুধু নিদর্শনই ছড়িয়ে আছে। এসব নিদর্শন সাক্ষ্য দিচ্ছে, গোটা এই বিশ্বজাহান একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি এবং তিনি একাই এর মালিক, শাসক ও ব্যবস্থাপক। আসমান ও যমীনে কোন জিনিসের নিদর্শন আছে তা বলার প্রয়োজন ছিল না। কারণ তখন বিবাদের মূল বিষয় ছিল এই যে, মুশরিকরা আল্লাহর সাথে অন্য সব খোদা এবং উপাস্যদের মানার জন্য জিদ ধরেছিলো। পক্ষান্তরে কুরআনের দাওয়াত ছিল এই যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই। তাই নিদর্শনসমূহ অর্থ যে তাওহীদের সত্যতা ও শিরক বাতিল হওয়ার নিদর্শন একথা বলা না হলেও পরিবেশ পরিস্থিতি থেকেই তা প্রকাশ পাচ্ছিলো।তাছাড়া এই যে বলা হয়েছে, “এসব হচ্ছে মু’মিনদের জন্য নিদর্শন” এর অর্থ, যদিও এগুলো সমস্ত মানুষের জন্যই নিদর্শন, কিন্তু এসব দেখে সঠিক সিদ্ধান্ত কেবল তারাই নিতে পারে যারা ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত। গাফলতির মধ্যে পড়ে থাকা মানুষ, যারা পশুর ন্যায় বেঁচে থাকে এবং একগুঁয়ে ও জেদী লোক, যারা না মানার সংকল্প করে বসেছে তাদের জন্য এগুলো নিদর্শন হওয়া না হওয়া সমান কথা। বাগানের চাকচিক্য ও সৌন্দর্য তো চক্ষুষ্মানদের জন্য। অন্ধরা কোন চাকচিক্য ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে না। তাদের জন্য বাগানের অস্তিত্বই অর্থহীন।
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং মানুষ ও জীব-জন্তুর সৃষ্টিতে, দিবারাত্রির আগমন-প্রত্যাগমনে এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে মৃত ভূমিকে পুনরায় জীবিত করে তোলা ইত্যাদি সহ সারা বিশ্বজাহানে এমন অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে, যা আল্লাহর একত্ব ও তাঁর প্রতিপালকত্বকে প্রমাণ করে।
কখনো হাওয়া উত্তর ও দক্ষিণমুখী হয়, কখনো পূর্ব ও পশ্চিমমুখী, কখনো সমুদ্রের হাওয়া আবার কখনো মরুর লু হাওয়া, কখনো হাওয়া রাতে চলে আবার কখনো দিনে, কোন হাওয়া বৃষ্টিবাহী, কোন হাওয়া ফলপ্রসূ, কোন হাওয়া আত্মার খোরাক (অক্সিজেন)। আবার কোন হাওয়া সব কিছুকে ঝলসে দেয়, কোন হাওয়া শুধু ধুলোবালির ঝড় বয়ে আনে। এত প্রকারের হাওয়াও প্রমাণ করে যে, এই বিশ্বজাহানের কেউ পরিচালক আছেন এবং তিনি একজনই। দু’জন বা তার অধিক নন। সমস্ত এখতিয়ারের মালিক তিনি একাই। এতে তাঁর কোন শরীক নেই। সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব কেবল তাঁরই হাতে। অন্য কারো হাতে সামান্য পরিমাণও কিছুর এখতিয়ার নেই। এই অর্থেরই আয়াত হল সূরা বাক্বারার ১৬৪নং আয়াতটি।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, এখানে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন নিদর্শন বর্ণনা করে এক জায়গায় বলা হয়েছে, এতে মু’মিনদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে, দ্বিতীয় জায়গায় বলা হয়েছে, বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তৃতীয় জায়গায় বলা হয়েছে, বিবেকবানদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। এতে বর্ণনা পদ্ধতির রকমফের ছাড়াও ইঙ্গিত রয়েছে যে, এসব নিদর্শন দ্বারা পূর্ণ উপকার তারাই লাভ করতে পারে, যারা ঈমান আনে, দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের জন্য যারা তৎক্ষণাৎ ঈমান না আনলেও অন্তরে বিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে যায় যে, এগুলো দলীল। এই বিশ্বাস কোন না কোন দিন ঈমানের কারণ হতে পারে। তৃতীয় পর্যায়ে তাদের জন্য উপকারী, যারা বর্তমানে মু’মিন ও বিশ্বাসী না হলেও সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী। কারণ, সুস্থ বুদ্ধিসহকারে এসব নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে অবশেষে ঈমান ও বিশ্বাস অবশ্যই পয়দা হবে। তবে যারা সুস্থ বিবেক রাখে না অথবা এসব ব্যাপারে বিবেককে কষ্ট দেয়া পছন্দ করে না, তাদের সামনে হাজারো দলীল পেশ করলেও যথেষ্ট হবে না।
আল্লাহর সত্ত্বা ও তার ইবাদতের ক্ষেত্রে “ওয়াহদানিয়াত” বা একত্বের সপক্ষে স্বয়ং আল্লাহর পেশকৃত এসব যুক্তি-প্রমাণ সামনে আসার পরও যখন এসব লোক ঈমান গ্ৰহণ করছে না। তখন এমন কি জিনিস আর আসতে পারে যার কারণে ঈমানের সম্পদ তাদের ভাগ্যে জুটবে? আল্লাহর কালামই তো সেই চূড়ান্ত বস্তু যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি এই নিয়ামত লাভ করতে পারে। আর একটি অদেখা সত্য সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য সর্বাধিক যুক্তি সঙ্গত যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করা সম্ভব তা এই পবিত্ৰ কালামে পেশ করা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ অস্বীকার করতেই বদ্ধপরিকর থাকে তাহলে করতে থাকুক। তার অস্বীকৃতির ফলে প্রকৃত সত্যের কোন পরিবর্তন হবে না।
কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এই আয়াত নদর ইবনে হারেছ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে, কোন কোন বর্ণনা থেকে হারেছ ইবন কালদাহ সম্পর্কে, আবার কোন এক বর্ণনা থেকে আবু জাহল ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হওয়ার কথা জানা যায়। আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তি বিশেষকে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজন নেই। كل শব্দ ব্যক্ত করছে যে, যে কেউ এসব বিশেষণে বিশেষিত, তার জন্যই দুর্ভোগ- একজন হোক অথবা তিন জন।
যে ব্যক্তি সদুদ্দেশ্যে খোলা মনে আল্লাহর আয়াতসমূহ শোনে এবং ঠাণ্ডা মাথায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তার এবং সেই ব্যক্তির মধ্যে অনেক পার্থক্য যে অস্বীকৃতির পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে তা শোনে এবং কোনো প্রকার চিন্তা ভাবনা ছাড়াই এসব আয়াত শোনার পূর্বেই যে সিদ্ধান্ত সে গ্রহণ করেছিলো তার ওপর স্থির থাকে। প্রথম প্রকারের ব্যক্তি এই আয়াত শুনে যদিও আজ ঈমান আনছে না কিন্তু তার কারণ এ নয় যে, সে কাফের থাকতে চায়। এর কারণ বরং এই যে, সে আরো নিশ্চিত হতে চায়। এ কারণে যদিও তার ঈমান আনায় বিলম্ব হচ্ছে তবু এটা অবশ্যই আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে অন্য কোন আয়াত হয়তো তার মনে ধরবে এবং সে নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত হয়ে ঈমান আনবে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তি কোন আয়াত শুনে কখনো ঈমান আনতে পারে না। কারণ, আল্লাহর আয়াতের জন্য সে আগে থেকেই তার মনের দরজা বন্ধ করে নিয়েছে। যেসব মানুষের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তারাই সাধারণত এই অবস্থার শিকার হয়। এক, তারা মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে। তাই সত্য ও সততা তাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। দুই, তারা দুষ্কৃতকারী হয়ে থাকে। তাই তাদের পক্ষে এমন কোন শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা মেনে নেয়া অত্যন্ত কঠিন হয় যা তাদের ওপর নৈতিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। তিন, তারা অংকারে আত্মমগ্ন থাকে যে, তারা সব কিছুই জানে কাজেই তাদেরকে আবার কে কী শিখাবে। এ কারণে তাদেরকে আল্লাহর যেসব আয়াত শুনানো হয় তারা তা আদৌ ভেবে চিন্তে-দেখার মত কোন জিনিস বলে মনে করে না এবং তাদের শোনা ও না শোনার ফলাফল একই হয়ে থাকে।
অর্থাৎ, একে তো তারা কুরআনকে মন দিয়ে শোনেই না এবং (শোনার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও) যদি কোন কথা তাদের কানে পড়ে যায় অথবা কোন কথা তাদের জ্ঞানে এসে যায়, তবে সেটাকে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপের বিষয় বানিয়ে নেয়। আর এটা করে তাদের ছোট জ্ঞান ও অবুঝ হওয়ার কারণে অথবা কুফরী ও অবাধ্যতার উপর অটল থাকার কারণে অথবা অহংকারের কারণে।
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন নিয়ে শত্রুদের শহরে সফর করতে নিষেধ করেছেন। এই আশংকায় যে, তারা হয়তো কুরআনের অবমাননা করবে। (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁর বাণীর অবমাননাকারীদের শাস্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তাদের পশ্চাতে রয়েছে জাহান্নাম। তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এবং সারাজীবন ধরে যেসব বাতিল মা’বুদের তারা উপাসনা করে এসেছে তারাও তাদের কোনই কাজে আসবে না। তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
مِنْ وَرَائِهِمْ جَهَنَّمُ শব্দটি আরবীতে ’পশ্চাৎ’ অর্থে বেশি এবং ‘সামনে’ অর্থে কম ব্যবহৃত হয়। অনেকেই এখানে ’সামনে’ অর্থ নিয়েছেন। তফসীরের সার সংক্ষেপে তাই করা হয়েছে। যারা ’পেছনে’ অর্থ নিয়েছেন, তাদের মতে উদ্দেশ্য এই যে, দুনিয়াতে তারা যেভাবে অহংকারী হয়ে জীবন-যাপন করছে, এর পেছনে অর্থাৎ পরে জাহান্নাম আসছে।
দুনিয়াতে যে মাল তারা অর্জন করেছে, যে সন্তান-সন্ততি এবং দল-বলের জন্য তারা অহংকার প্রদর্শন করে থাকে, এ সব কিছুই কিয়ামতের দিন তাদের কোনই উপকারে আসবে না। যাদেরকে দুনিয়াতে নিজেদের আলিয়া, অভিভাবক, বন্ধু, সাহায্যকারী এবং উপাস্য বানিয়ে রেখেছিল, সেদিন তারা তাদের নজরেই পড়বে না। তারা সাহায্য আর কি করবে?
هٰذَا (এ) অর্থাৎ, কুরআন সৎপথের দিশারী। কারণ, এর অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে কুফরী ও শিরকের অন্ধকার থেকে বের করে ঈমানের আলোয় নিয়ে আসা। তাই এটা যে পূর্ণ হিদায়াত ও সৎপথের দিশারী গ্রন্থ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ থেকে হিদায়াত তো সে-ই পাবে, যে এর জন্য স্বীয় বক্ষকে উন্মুক্ত করে দেবে। অন্যথা সে ব্যক্তি কিভাবে পথ পাবে, যে পথের খোঁজই করে না?
ফুটনোট
➤ আল্লাহ তা‘আলা সূরার প্রথমেই তাঁর ক্ষমতার ও এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে এমন কিছু বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলা ছয়টি জিনিষের বর্ণনা করেছেন যা প্রমাণ করে যে, তিনিই একমাত্র প্রতিপালক, আর ইবাদতের যোগ্যও তিনিই, অন্য কেউ নয়, বিষয়গুলো হলো- (১) আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি। (২) মানব জাতির সৃষ্টি। (৩) চতুষ্পদ জন্তুর সৃষ্টি। (৪) দিবা-রাত্রির পরিবর্তন। (৫) আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে মৃত জমিনকে জীবিতকরণ এবং (৬) বায়ুর পরিবর্তন- এ প্রত্যেকটিই আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে।
➤ আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে যাতে মানুষ তা অনুসরণ করে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।
➤ বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনা একই উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই দুইয়ের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় রয়েছে।
➤ আল্লাহর কিতাবের আয়াত এবং আল্লাহর সৃষ্টিজগত উভয় স্থানে ঈমানদার ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।
➤ সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন নিদর্শন বর্ণনা করে বলা হয়েছে, এতে মু’মিনদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে, দ্বিতীয় জায়গায় বলা হয়েছে, বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে এবং তৃতীয় জায়গায় বলা হয়েছে, বিবেকবানদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।
➤ আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে যাতে মানুষ তা অনুসরণ করে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।
➤ বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনা একই উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই দুইয়ের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় রয়েছে।
➤ আল্লাহর কিতাবের আয়াত এবং আল্লাহর সৃষ্টিজগত উভয় স্থানে ঈমানদার ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।
➤ কুরআন আমাদেরকে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে। একমাত্র চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমরা জেনেবুঝে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে এবং নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হতে পারি।
➤ আমরা যেন মেঘ, বৃষ্টি, বাতাস, তুষারপাত ইত্যাদিকে সাধারণ ঘটনা মনে না করি। এসব প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহ সুনির্দিষ্ট নিয়মে সংঘটিত না হলে পৃথিবীতে মহা বিপর্যয় দেখা দেবে এবং মানুষসহ অন্যান্য জীবনজন্তু না খেয়ে মারা যাবে।
➤ আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাব নাজিল করে মানুষের প্রতি নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। এই কিতাব পাওয়ার পরও যদি কেউ ঈমান না আনে তাহলে সেজন্য সে কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না।
➤ ৮ নং আয়াতে দুই প্রকার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে- প্রথম প্রকারের ব্যক্তি এই আয়াত শুনে যদিও আজ ঈমান আনছে না কিন্তু তার কারণ এ নয় যে, সে কাফের থাকতে চায়। এর কারণ বরং এই যে, সে আরো নিশ্চিত হতে চায়। দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তি কোন আয়াত শুনে কখনো ঈমান আনতে পারে না। কারণ, আল্লাহর আয়াতের জন্য সে আগে থেকেই তার মনের দরজা বন্ধ করে নিয়েছে।
➤ দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তিদের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান-
এক, তারা মিথ্যাবাদী হয়ে থাকে
দুই, তারা দুষ্কৃতকারী হয়ে থাকে
তিন, তারা অংকারে আত্মমগ্ন থাকে
➤ অহংকার একটি খারাপ গুণ। সেই অহংকার যদি আল্লাহর সামনে করা হয় তাহলে তার মাত্রা আরো বেড়ে যায় এবং জেনেবুঝে সেই অহংকারে অটল থাকার অপরাধ আরো অনেক অনেকগুণ বেশি।
➤ আল্লাহর বাণী সব মানুষের কানে পৌঁছে দিতে হবে। এমনকি এ কাজে চরম পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিও যেন বাদ না যায়। তাহলেই তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন সম্পন্ন হবে।
➤ বান্দার গোনাহের ধরন অনুযায়ী তার শাস্তি নির্ধারিত হবে। এ কারণে ঠাট্টা করার শাস্তি হবে অপমান ও লাঞ্ছনা।
➤ কাফিররা পার্থিব জগতে সম্পদ, ক্ষমতা ও বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু পরকালে এগুলোর কোনোটিই কাজে আসবে না।
➤ আল্লাহর হিদায়াতকে যে অস্বীকার করে সে পাপের পথে ডুবে যায় এবং পরকালে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।